জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আপিলের প্রেক্ষাপটে আপিল বিভাগ আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টকে নির্দেশ দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য দ্রুততার সাথে গৃহীত আইনী পদক্ষেপ যথাযথ ও সময়োপযোগী ছিল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ ধারণা ছিল যে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে এবং খালেদা জিয়ার জামিন হোক, বা না হোক তিনি হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। যেহেতু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্ণীতির অপরাধ প্রমাণিত, তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে খুব শীগগিরই উচ্চ আদালতেও খালেদা জিয়ার সাজা বহাল থাকবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ছাড়া খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সাজা ভোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার আপাতদৃষ্টিতে কোনো উপায় নেই।
জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকা অবস্থায় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে হাইকোর্টে আপিলের শুনানি শেষে যদি খালেদা জিয়ার সাজা বহাল থাকে তাহলে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন তিনি।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে হাইকোর্টকে খালেদা জিয়ার পক্ষে করা আপিল নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার জামিন মঞ্জুর করে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল বহাল রাখার পাশাপাশি ওই নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। এরই মধ্যে হাইকোর্টে আপিলের ওপর শুনানির প্রস্তুতি নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আপিল বিভাগের রায়ের কপি পাওয়ার পরপরই দ্রুত ওই শুনানির জন্য উদ্যোগ নেবে তারা।
এ সম্পর্কে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, আপিল বিভাগ সময় বেঁধে দেওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জন্য অসুবিধার সৃষ্টি হলো। তিনি বলেন, ‘কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না যে মামলায় খালেদা জিয়া খালাস পাবেন, নাকি তাঁর আপিল খারিজ হবে। যদি তাঁর আপিল খারিজ হয়ে যায় তাহলে তো অসুবিধা হবেই। আর খালাস পেলে তো বেঁচেই গেলেন।’
বিএনপিপন্থী অনেক আইনজীবীই মনে করেন, আপিল বিভাগের ওই নির্দেশ খালেদা জিয়ার জন্য খারাপই হয়েছে। এ বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় এই খারাপ দিকটা ভাবা হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকা অবস্থায় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে হাইকোর্টে আপিলের শুনানি শেষে যদি খালেদা জিয়ার সাজা বহাল থাকে তাহলে ওই নির্বাচনে তাঁর প্রার্থী হওয়া ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকলে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন তিনি। তাঁরা মনে করছেন, তাড়াতাড়ি কারামুক্তির চেষ্টা করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়েছে খালেদা জিয়ার জন্য।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলেন, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার আপিল নিষ্পত্তি হলে সেই রায় প্রভাব ফেলবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। খালেদা জিয়ার সাজা বহাল থাকলে তাঁর আইনজীবীদের দ্রুত আপিল বিভাগে আপিল করতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ বা দুদক তা দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেবে, যেমনটি করছেন হাইকোর্ট বিভাগে। তাতে সাজা বহাল থাকলে খালেদার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া প্রশ্নের মুখে পড়বে।
সংবিধান অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দুই বছর বা তার অধিক সাজা হলে এই সাজা ভোগ শেষে পরবর্তী পাঁচ বছর নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না; যদি (ঘ) ‘নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আপিল বিভাগ যেকোনো আদেশ নির্দেশ দিতেই পারেন। আপিল বিভাগের রায় একটা আইন। সেটা মানা সকলের জন্যই বাধ্যতামূলক। আর এ কারণে আপিল বিভাগের রায় এমন হতে হবে যাতে সকলের জন্যই তা সমান হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘হাইকোর্ট বিভাগে এখন অনেক পুরনো আপিল বিচারাধীন রয়েছে। এ কারণে অনেককেই কারাগারে বন্দি থাকতে হচ্ছে। খালেদা জিয়ার আপিল ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে খালেদা জিয়ার আপিল শুনানি হবে আগেই।’
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ছাড়াও আরও কয়েকটি মামলা চলছে। রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের বিপরীতে মামলাগুলোতে জামিনের জন্য আলাদাভাবে আইনি লড়াই করতে হবে। আইনের এ পর্যায়গুলো সম্পর্কে কি খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা অবগত নন? তারা সকলেই ঝানু আইনজ্ঞ হলেও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তাদের আন্তরিকতার অভাব ছিল বলে মনে হয়েছে। রায়ের কপি সংগ্রহ থেকে শুরু করে আপীল পর্যন্ত তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। ড. কামাল হোসেনও এ মামলায় পরামর্শ দিবেন বলে জানিয়েছিলেন।
এখন প্রশ্ন ওঠেছে স্বাভাবিক যে, মওদুদ আহমেদ বা জয়নুল আবেদীনের মত বিজ্ঞ আইনজ্ঞদের কি অজানা ছিল যে, আপিল খারিজ হয়ে গেলে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড চূড়ান্ত হয়ে যাবে! তারেক রহমানের নির্দেশ ছাড়া আইনজীবীদের পক্ষে কি এটা সম্ভব ছিল?