একাত্তরের ২৩ মার্চ বাংলাদেশে পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। এদিন সারা বাংলায় উড়ছিল মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা।
ঢাকা সেদিন পরিণত হয় পতাকার নগরীতে। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে জানা যায়, কড়া পাহারায় প্রেসিডেন্ট ভবন, গভর্নর হাউস, সেনানিবাস ও বিমানবন্দর ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি।
ওই সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ছিলেন পিপিপি প্রধান ভুট্টো। ওই হোটেলেও সেদিন স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ে।
শহীদ জননী জাহানা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ে লিখেছেন, “আজ প্রতিরোধ দিবস। খুব সকালে বাড়িসুদ্ধ সবাই মিলে ছাদে গিয়ে কালো পতাকার পাশে আরেকটা বাঁশে ওড়ালাম স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন পতাকা। বুকের মধ্যে শিরশির করে উঠল।”
ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কনসুলেট ভবনেও এদিন বাংলার পতাকা ওড়ে। যুক্তরাজ্যের ডেপুটি হাই কমিশন ও সোভিয়েত কনসুলেটে সকাল থেকেই স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়েছিল। চীন, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল নিজেদের পতাকার পাশে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ালেও জনদাবির মুখে তা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলে।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এদিন সাধারণ ছুটি পালিত হয়। পল্টন ময়দানে জাতীয় পতাকা ওড়ায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
তখনকার ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী এই দিনের স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, “স্পষ্ট মনে আছে, বিউগল আর ড্রাম বাজিয়ে সুরের মূর্ছনায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানের সুর পল্টনে উপস্থিত সব মানুষের চিত্তকে উদ্বেলিত করছিল।
“সত্যিকারের স্বাধীনতার আস্বাদন পাচ্ছিল বাংলার দুর্জয় ও অকুতোভয় জনতা। মোস্তফা মহসীন মন্টু, খসরু, হাসানুল হক ইনু, মহানগর ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সম্মিলিতভাবে আস্তে আস্তে পতাকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করেন।
“এ সময় সামরিক কায়দায় মঞ্চে দণ্ডায়মান স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতাকে অভিবাদন প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি হিসেবে আমরা অভিবাদন গ্রহণ করি।
“ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেক ব্রিগেড সাজানো হয়েছিল। একটির পর একটি ব্রিগেড অভিবাদন জানিয়ে মঞ্চ অতিক্রম করে পাশে অবস্থান নিচ্ছে, আরেকটি ব্রিগেড মঞ্চের দিকে মাথা বাঁকিয়ে অভিবাদন দিয়ে প্যারেড করে এগিয়ে যাচ্ছে।
“শেষ ব্রিগেডটি অভিবাদন জানানোর পর আমরা মঞ্চ থেকে নেমে পল্টনের গেটে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে গেলাম। সেখান থেকে ব্যান্ড বাজিয়ে বিউগলে জাতীয় সংগীতের সুর তুলে মিছিল করে দৃপ্ত পদভারে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে চললাম।”
এদিন সাধারণ ছুটি থাকায় জনতার ঢল নামে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মিছিলের পর মিছিল আসতে থাকে। সবার হাতে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা।
বাঁ হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে ধরে ডান হাত জনতার উদ্দেশে বাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলার মানুষ কারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই তারা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনবে।“
পরদিন এই প্রতিরোধ দিবসের খবরে ব্যানার শিরোনাম করে দৈনিক ইত্তেফাক। রবীন্দ্রনাথের গান থেকে উদ্ধৃত করে ওই শিরোনাম ছিল, “আমরা শুনেছি ঐ, মাভৈ: মাভৈ: মাভৈ:”।
ঢাকা টেলিভিশনের বাঙালি কর্মীরা এদিন অভূতপূর্ব এক কাজ করেন। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান এদিন মধ্যরাত পেরিয়ে আরও ৯ মিনিট চলে। বাজেনি পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত। পর্দায় পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি।
জাহানারা ইমাম লিখেছেন, “টেলিভিশনের অনুষ্ঠান যে আজকে শেষই হয় না। অন্যদিন সাড়ে ৯টার মধ্যে সব সুনসান। আজ দেখি মহোৎসব চলছে তো চলছেই। সুকান্তর কবিতার উপর চমত্কার দুটো অনুষ্ঠান হল। একটা ‘ছাড়পত্র’ – মোস্তফা মনোয়ারের প্রযোজনা। ড. নওয়াজেশ আহমেদের ফটোগ্রাফির সঙ্গে কবিতার আবৃত্তি।
“আরেকটা ‘দেশলাই’- বেলাল বেগের প্রযোজনা। সুকান্তর দেশলাই কবিতার আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে টিভি পর্দায় দেখা গেল অসংখ্য দেশলাইয়ের কাঠি একটার পর একটা জ্বলে উঠছে। একটা কাঠি থেকে আরেকটাতে আগুন ধরতে ধরতে সবগুলো মশালের মত জ্বলতে লাগল পুরো টিভি পর্দা জুড়ে।
“এরপর শুরু হল আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটক ‘আবার আসিব ফিরে’। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ একটি ছেলের বিস্মৃতপ্রায় স্মৃতি আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে একাত্তরের গণআন্দোলনে। নাটক ২৩ মার্চের রাত পৌনে ১১টায় শুরু হয়ে শেষ হয় ২৪ মার্চের প্রথম প্রহরে।
“টেলিভিশনে ঘোষক সরকার ফিরোজ উদ্দিন সমাপনী ঘোষণায় বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা বেজে ৯ মিনিট – আজ ২৪শে মার্চ, বুধবার। আমাদের অধিবেশনের এখানেই সমাপ্তি’।
“এরপর পাকিস্তানি ফ্ল্যাগের সঙ্গে ‘পাক সারজমিন শাদবাদের’ বাজনা বেজে উঠল। এতক্ষণে রহস্য বোঝা গেল। ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবসে বীর বাঙালিরা টেলিভিশন পর্দায় পাকিস্তানি পতাকা দেখাতে দেয়নি।”
এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হয়নি। তবে দুজনের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে দুই দফা বৈঠক হয়। প্রথম বৈঠক দুপুর ১২টা থেকে একঘণ্টা এবং দ্বিতীয় বৈঠক সন্ধ্যা ৬টা থেকে দুঘণ্টা চলে। এতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন। ইয়াহিয়ার পক্ষে ছিলেন বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা, এম এম আহমদ ও কর্নেল হাসান।
এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘পাকিস্তান দিবস’ (২৩ মার্চ) এর বাণীতে মিথ্যাচার অব্যাহত রাখেন। তার বাণীতে লেখা ছিল, “নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মিলেমিশে একসঙ্গে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান এখন এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত। গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের পথে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। তবে আমরা যদি আমাদের লক্ষ্যে অবিচল থাকি তাহলে কোনো কিছুই আমরা হারাব না।”
এদিন বাংলাদেশে চলাচলে পাকিস্তানের বিমান ও জাহাজকে মালদ্বীপের ব্রিটিশ ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার খবর প্রকাশ করে ইত্তেফাক।