২২ মার্চ ১৯৭১। দিনটি ছিল সোমবার। লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ২১তম দিবস। স্বাধিকার তথা স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষুব্ধ মানুষের সভা, শোভাযাত্রা এবং গগনবিদারী স্লোগানে রাজধানীর আকাশ-বাতাস মুখরিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ডাকে রক্তঝরা উত্তাল অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিটি দিনই ছিল বৈপ্লবিক। গত ২১টি দিন যাবত বাংলার মানুষ মরণপণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত নেতার বৈধ নির্দেশসমূহ বাস্তবায়ন করে এই প্রথমবারের মতো এ সত্য প্রমাণ করেছে যে বাঙালী জাতি স্বশাসন নিশ্চিত করতে জানে।
ইয়াহিয়া মুজিবের বৈঠকের পরিণতি কি হবে, তাও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। গতকাল আবার ভুট্টো এসেছে বারোজন উপদেষ্টা নিয়ে। ভীষণ কড়া মিলিটারি প্রহরায় প্লেন থেকে নেমেছে। হোটেল ইন্টারকনে আছে, যেখানে ভয়ানক কড়াকড়ি সিকিউরিটি। গতকাল এসেই ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে দু’ঘন্টা মিটিং করেছে। অথচ ইয়াহিয়া যেদিন এলো, সেদিন সারাদিন শেখ মুজিবের কোনো খোঁজই করলো না। কেমন যেন একটা ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র ভাব মনে হচ্ছে। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে জ্বলন্ত বালিতে খৈ ফুটছে। ইয়াহিয়া, শেখ মুজিব, ভুট্টো বৈঠক করছে, দেশের সর্বশ্রেণীর লোক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক সবাই নিজ নিজ পেশার ব্যানারে মিটিং মিছিল করছে। জয়দেবপুরে মিলিটারি জনতার উপর গুলিবর্ষণ করেছে। টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জে তার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। ঢাকার মিরপুরে, চট্টগ্রামে, পার্বতীপুর সৈয়দপুরে বিহারী বাঙালি খুনোখুনি রক্তারক্তি হচ্ছে মিলিটারী বিহারীদের উস্কানি আর সাপোর্ট দিচ্ছে।
এ রকম বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির মধ্যে সকাল সাড়ে ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। প্রায় ৭৫ মিনিটব্যাপী আলোচনা শেষে দেশের আপামর জনসাধারণের মুক্তিদূত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু দৃঢ় অথচ বিষণ্ণ অবয়বে প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার নির্ধারিত বৈঠক ছিল। সে অনুযায়ী আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যাই। সেখানে মিঃ ভুট্টো উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি যে, ৪টি শর্ত পূরণ না হলে আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে পারি না।’
আসলে আজকের আলোচনায় ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার আচরণে জনমনে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং ভুট্টো আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে গণহত্যার পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। অর্থাৎ আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি।
এদিকে দুপুরে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে কড়া সামরিক পাহারায় হোটেলে ফিরে ভুট্টো তার উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। ভুট্টো ফেরার সময় হোটেলের বাইরে ভুট্টো-বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন বিক্ষুব্ধরা।
সাংবাদিকদের ভুট্টো-বিরোধীদের অবস্থানের ছবি ও খবর সংগ্রহ করার একটি আলোকচিত্র পরদিন ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়।
ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপলস পার্টির নেতারা সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে যান। রাতে সেখান থেকে ফিরে ভুট্টো হোটেল লাউঞ্জে সংবাদ সম্মেলন করেন।
আজ পত্রিকায় প্রেরিত এক বিশেষ বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের বৈধতার কারণে বিজয় এখন থেকে আমাদেরই।’
বাংলাদেশের সকল দৈনিক পত্রিকার জন্য প্রেরিত এ বাণীটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের মুক্তি।’ বাণীতে সাত কোটি বাঙালীর সামগ্রিক মুক্তির জন্য চলমান আন্দোলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে। বুলেট, বেয়নেট এবং বন্দুক দ্বারা বাংলাদেশের মানুষকে স্তব্ধ করা যাবে না, কারণ তারা আজ ঐক্যবদ্ধ। আমাদের লক্ষ্য অর্জনে যে কোন প্রকার আত্মত্যাগে আমরা প্রস্তুত। যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করতে বাংলাদেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।’
সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে প্রদত্ত বাণীটিতে রয়েছে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কর্তৃক আসন্ন গণহত্যার চক্রান্ত প্রতিহত করার এবং প্রস্তুতি গ্রহণের সতর্ক সঙ্কেত।
এদিকে সন্ধ্যায় সংবাদপত্রে প্রেরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছেন, ‘পাকিস্তানের উভয়াংশের নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সমঝোতার ক্ষেত্র অধিকতর প্রসারিত করার সুবিধার্থে ২৫ মার্চে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো।’
পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কবে বসবে এ রকম কোন দিন তারিখ উল্লেখ না করেই বিবৃতিটি প্রদান করা হয়। এদিকে রাজধানী ঢাকায় অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানের তিনটি পার্লামেন্টারি গ্রুপের নেতৃবৃন্দ ওয়ালী খান, দৌলতানা এবং মুফতি মাহমুদ প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা এখনো বিশ্বাস করি যে, যে কোন রকম জাতীয় ইস্যুতে আলোচনার এবং মীমাংসার সর্বাপেক্ষা উত্তম স্থান হচ্ছে জাতীয় পরিষদ।’
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় তারাও বুঝেছিলেন যে, ইয়াহিয়া খান শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধানে আন্তরিক নন।
প্রতিদিনের ন্যায় আজও বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঢেউয়ের মতো একের পর এক শান্তিপূর্ণ ও নিয়মানুগ মিছিলের স্রোত আসতে থাকে। এদিন জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মিছিলের ঢল ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যায়। দৈনিক পত্রিকাগুলো পরদিন সেই খবর প্রকাশ করে লেখে, একদিনে এত মিছিল এর আগে কখনও ৩২ নম্বরে যায়নি।
বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের মিছিলের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগ ও আমাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত করেছে। সুতরাং শাসন করার বৈধ অধিকার কেবল আমারই আছে। বুলেট এবং বেয়নেটের মাধ্যমে যত ষড়যন্ত্রই চলুক না কেন সমগ্র বাংলাদেশ আজ জাগ্রত, বাঙালী জাতি আজ একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল ও ঐক্যবদ্ধ। সুতরাং জয় আমাদের সুনিশ্চিত।’
যে কোন ধরনের আপোস মীমাংসার বিরুদ্ধে স্লোগানরত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যদি তারা দ্রুত আমাদের ৪ দফা দাবি মেনে নেয় তাহলে এখনও পর্যন্ত আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে বসবাস সম্ভব।’
জনতার গগনবিদারী ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি ও করতালির মধ্যে জনগণের নেতা ঘোষণা করেন, “সাত কোটি বাঙালি যখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখন আমি অবশ্যই দাবি আদায় করে ছাড়ব।”
তিনি বলেন, “২৩ বছর মার খেয়েছি, আর মার খেতে রাজি নই। শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। প্রয়োজন হলে আরও রক্ত দেব। কিন্তু এবার সুদে-আসলে বাংলার দাবি আদায় করে আনব।”
এদিন বিদেশী টেলিভিশনের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচিত বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করার নৈতিক বৈধতা কেবলমাত্র আমারই রয়েছে, অন্য কারও নয়।’
এদিন বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকেরা সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ করেন। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছে, তাতে তারা আর প্রাক্তন হিসেবে বসে থাকতে পারেন না।
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী লিখেছেন, ঢাকার কয়েকটি পত্রিকায় এদিন ‘বাংলার স্বাধিকার’ শিরোনামে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত একটি বাণী।
ওই ক্রোড়পত্রে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রবন্ধ লেখেন। অবজারভার গ্রুপের পত্রিকাগুলো সেদিন এই ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেনি। তারা পরদিন ছাপে। এই ক্রোড়পত্রে মূল পরিকল্পনায় ছিলেন নাট্য আন্দোলনের কর্মী রামেন্দু মজুমদার।