একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিপরীতে, তার সমকক্ষ অথবা প্রতিপক্ষ হিসেবে সাবেক সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানকে দাঁড় করানোর একটা অপচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই চালানো হচ্ছে। বিএনপির নেতাকর্মীর ধারাবাহিকভাবে এই অপতৎপরতা চালাচ্ছে। কখনও স্বাধীনতার ঘোষক, কখনও বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানকে গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ নেতা হিসেবে জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় কখনই এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। এমনকি তিনি নিজেও পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ‘‘বাঙালির নির্বাচিত প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাকারী একমাত্র জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, যার আহ্বানে সাড়া দিয়েই সবাই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’’ জিয়ার এ বক্তব্যের পরও যারা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু এবং জাতির জনকের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন, তাদের পরিষ্কার উদ্দেশ্যটিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরোধিতা করা, ’৭১-পূর্ববর্তী রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রবর্তন করা।
বঙ্গবন্ধুর বিপরীতে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন জিয়াপুত্র ও বিএনপির ‘ভবিষ্যৎ কান্ডারী’ হিসেবে বর্ণিত তারেক রহমান। তারেক রহমান একাধিকবার বলেছেন, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। ২৬ মার্চের ঐ দিনের ঘোষণায় ইথারে দেশের ৭ কোটি মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছিল। জিয়াউর রহমানে ঘোষণা দিকহারা জাতিকে পথের দিশা দিয়েছিল।” তারেকের মতে, ৭ মার্চ নয় দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চই প্রথম দিয়েছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার ঘোষণাই বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জ্বীবিত করে।
তারেক রহমানের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও স্বামী জিয়াউর রহমানকে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। কারণ, স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়াউর রহমান। তারা (আওয়ামী লীগ) যতই বলুক না কেন জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি; প্রকৃত ইতিহাস হচ্ছে, স্বাধীনতার ঘোষক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলেই আওয়ামী লীগ জিয়াকে ভয় পায়। সে জন্য তারা ওই ঘোষণাকে স্বীকৃতি দিতে চায় না (সমকাল, ২৮ মার্চ ২০১৪)।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তার সকল শক্তি নিয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালিদের ওপর। প্রথম আঘাতটা হয় ঢাকার ওপর। কিন্তু শীঘ্রই পাকিস্তানিদের আক্রোশ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাংলাদেশে। ২৫ মার্চ রাতে সাধারণ নাগরিকরা ঘুমিয়ে ছিল তাদের ঘরে। ছাত্রাবাসের ছাত্ররা, ব্যারাকের পুলিশ আর রাইফেলসের সদস্যরা তাদের রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল আগের দিন পর্যন্ত। রাতের আক্রমণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও ইকবাল (পরে সার্জেন্ট জরুহুল হক) হলের অনেক ছাত্র মারা যায়। তাদের ধরে এনে খেলার মাঠে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারে পাকিস্তানি সৈন্যরা। সারা শহরে যেখানে সেখানে তারা হত্যা করে সাধারণ মানুষকে। তবে তাদের রুখে দাঁড়ায় ছাত্ররা, পুলিশ এবং রাইফেলস এর সদস্যরা। শুরু হয় আমাদের প্রতিরোধ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। বাকি ইতিহাস আমাদের জানা। কিন্তু এই জানা ইতিহাস এখন অজানা হয়ে যাচ্ছে। বিকৃত হয়ে যাচ্ছে সত্য ঘটনাগুলো। কিন্তু এই বিকৃতি একটি জাতির জন্য অপমানজনক। এই বিকৃতি রুখতে হবে। সত্য ইতিহাসটা দেশের মানুষকে জানাতে হবে। দেশের সবচেয়ে বেশি গৌরবের ইতিহাসটা থেকে মিথ্যার অংশটা ফেলে দিতে হবে। এজন্য কোনো দল নয়, বরং দেশের জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাকে দেখতে হবে, পড়তে হবে। এজন্য আমাদের প্রথমেই কিছু প্রশ্ন করতে হবে। আমাদের জানতে হবে কেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? কি ছিল তার পটভূমি? কারা ছিলেন সেই মুক্তিযুদ্ধের পেছনে? কারা করেছিলেন সেই যুদ্ধ? কেন করেছিলেন? এবং সেই যুদ্ধের পর কেমন বাংলাদেশ আশা করেছিলাম আমরা?
মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো আমাদের প্রিয় ভূ-খন্ডটিকে পাকিস্তানি শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার জন্য। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান হলো, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ অধীনস্ত হলো পাকিস্তানিদের। শাসক বদলালো মাত্র, ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। বরং আরও অবনতি হলো। একটি নতুন দেশে মর্যাদা ও সমতার ভিত্তিতে জীবনযাপনের যে স্বপ্ন শুরুতে ছিল, তা খুব দ্রুত ধূলিসাৎ হলো। পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার প্রসঙ্গটি সামনে এনে শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের জানিয়ে দেয়, মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে, শোষণ ও শাসনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে হলে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। ১৯৫২’তে শুরু তারপর পাকিস্তানিদের আক্রমণ, শোষণ ও বঞ্চনা যত বাড়তে থাকল, তত বাড়ল আমাদের প্রতিরোধও। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন এল, বাঙালিদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রাও বেড়ে গেল। বাংলাদেশের ছাত্রজনতাও এরপর এক দীর্ঘ সংগ্রামে নামল। ১৯৬২ এর শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফার আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ তথা বাঙালির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পথ ধরে শুরু হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক কারণ ছিল, অর্থনৈতিক, সামাজিক কারণ ছিল, সাংস্কৃতিক কারণ ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল একটি স্বাধীন দেশে প্রকৃত স্বাধীনতা নিয়ে যাতে মানুষ সার্বিকভাবে বিকশিত হতে পারে, তা নিশ্চিত করা। এর প্রেক্ষাপটটিও তাই ছিল দীর্ঘ এবং তা একদিনে তৈরি হয়নি। এর জন্য প্রয়োজন হয়েছে দীর্ঘ প্রস্তুতির, ত্যাগের- আত্মদানের।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস। ১৯৭১ সালের আগের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে বৈষম্যগুলো চলেছে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয় এবং ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান দুই হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত হয়, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে অবস্থিত এ দুটি অংশের মধ্যে মিল ছিল কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এর পূর্ব অংশ পশ্চিম অংশের তুলনায় নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। মোট জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। পাকিস্তানের মূল শাসকগোষ্ঠী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। পশ্চিমা শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিমাতাসূলভ আচরণ করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান চরম অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়। এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তান সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে এবং মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বাধতে শুরু করে।
এরপর আসে ভাষা আন্দোলন। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপরও নিপীড়ন শুরু হয় এবং এর প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় যখন পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দেন ‘উর্দু এবং কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন জনগোষ্ঠী এই ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্যে এই আন্দোলন তীব্রতম রূপ ধারণ করে। এদিন পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেকে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে হয়। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতেও বাঙালিরা অবহেলিত ছিল। সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন অংশে সমগ্র বাহিনীর মাত্র ৫ শতাংশ ছিল বাঙালি অফিসার এবং এদের মধ্যে অধিকাংশই প্রযুক্তিগত বা ব্যবস্থাপনার পদে ছিলেন। খুব অল্প সংখ্যক বাঙালি অফিসার আদেশদানকারী পদ লাভের সুযোগ পেতেন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করত বাঙালিরা পশতুন বা পাঞ্জাবীদের মত সাহসী নয়। পাকিস্তানের বাজেটের একটি বিশাল অংশ সামরিক খাতে বরাদ্দ থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান এর সুফল সামান্যই পেত।
অপরদিকে রাজনৈতিক দিক দিয়েও ছিল প্রচন্ড অসমতা। জনসংখ্যার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান দেশের বৃহত্তর অংশ হওয়া সত্ত্বেও দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তান কুক্ষিগত করে রাখে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ক্ষমতার বন্টন পূর্ব পাকিস্তানের অনুকূল হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তান এক ইউনিট তত্ত্ব নামে এক অভিনব ধারণার সূত্রপাত করে, যেখানে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান একটি প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের ভোটের ভারসাম্য আনা। যখনই পূর্ব পাকিস্তানের কোনো নেতা, যেমন খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুড়া, অথবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতেন, তখনই পশ্চিম পাকিস্তানিরা কোনো না কোনো অজুহাতে তাদের পদচ্যুত করত। নানারকম টালবাহানা করে জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করে নেন এবং দীর্ঘ ১১ বছর ধরে পাকিস্তানে তার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালু থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের এই অনৈতিক ক্ষমতা দখল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়েই চলে। এভাবে নানা দিকে বঞ্চিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। ক্ষোভ ক্রমেই দানা বাঁধতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যার চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে।
লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার – জেষ্ঠ্য সাংবাদিক।