স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে থেকেই সারা বিশ্ব দুটি বলয়ে (ন্যাটো ও ওয়ারশ) বিভক্ত ছিল। একটি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত, অন্যটি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার পূর্ব ইউরোপীয় (ওয়ারশভুক্ত দেশ) মিত্রদের নিয়ন্ত্রিত। সেই ‘কোল্ড ওয়ার’ বা ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু তার বেতার ভাষণে বলেন, ‘আজ বিশ্বজুড়ে যে ক্ষমতার লড়াই চলছে, সে ক্ষমতার লড়াইয়ে আমরা কোনো মতেই জড়িয়ে পড়তে পারি না। এজন্য আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে। কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়, সবার প্রতি বন্ধুত্ব—এ নীতির ভিত্তিতে বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী।’
বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ভাষণে যে পথরেখা নির্দেশ করেছিলেন, সেটি ধরেই প্রবাসী মুজিবনগর সরকার তাদের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করেছিল। স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে পদার্পণ করেই তার এ পররাষ্ট্রনীতির পুনরাবৃত্তি করেন। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধে যেহেতু তত্কালীন সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারত সরাসরি সহায়তা করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে সেহেতু প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের গভীরতা বেশি ছিল। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিসংগ্রামে বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহায়তাদানের জন্য বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, তার সরকার ও জনগণকে বিশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন, সহায়তা ও জাতিসংঘে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন এবং যুদ্ধের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর পাঠানোর ঘোষণার প্রেক্ষাপটে সোভিয়েত ইউনিয়নের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার জনগণকে ধন্যবাদ জানান।
এছাড়া আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন করায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এবং ফ্রান্স ও ব্রিটেনের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, কতিপয় কংগ্রেসম্যান, মিডিয়া এবং সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ, সংবাদপত্র ও নেতাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
বঙ্গবন্ধু চীনের প্রতি আবেদন রেখে বলেন, ‘আশা করি, চীন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরোচিত সাফল্যকে স্বীকৃতি দেবে। কারণ চীনও যুদ্ধবাজ, স্বৈরতন্ত্রী ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।’
মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা, প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়দান এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলে ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে চূড়ান্ত বিজয় ত্বরান্বিত করায় বঙ্গবন্ধু প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। লন্ডন থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনকালে ৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করে রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ভারতের সরকার ও জনগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
লন্ডনে যাত্রাবিরতিকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে আলোচনার সময় বাংলাদেশকে ব্রিটেনের স্বীকৃতি ও কমনওয়েলথের সদস্যভুক্তির জন্য অনুরোধ করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর শিগগিরই প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করেন। দিল্লিতে যাত্রাবিরতিকালে বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি উত্থাপন করতে ভোলেননি। সেখানে সংক্ষিপ্ত অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যবহার ও সুকৌশলী আচরণ তার সহকর্মীদের মুগ্ধ করে। তিনি ঢাকায় আসার পথে ব্রিটিশ রাজকীয় জেট বিমান কমেট পরিবর্তন করে ভারতীয় বিমানে আসা শোভনীয় মনে করেননি। তিনি ব্রিটিশ বিমানে করেই ঢাকায় আসেন। তাছাড়া আসার পথে পুনরায় কলকাতায় যাত্রাবিরতিও তিনি কৌশলে বাদ দেন।
বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশ পরিচালনা শুরুর পর থেকে একে একে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে থাকে।
১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রাণের স্পন্দন লক্ষ করা যায়। কলকাতা প্যারেড গ্রাউন্ডে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া শহরের আরো দশটি পার্কে লাখ লাখ লোক জমায়েত হয়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শোনে।
আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু বিজয়ের ৫০ দিনের মধ্যে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার নিশ্চিত করেন। ১৯৭২-এর ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিদায় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু নিজেও উপস্থিত ছিলেন। ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দুদিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। তার এ সফরের মধ্য দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় এবং সহযোগিতার নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়। এ সফরের সময়ই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি বন্ধুত্ব, শান্তি ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
১৯৭২ সালের ২-৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নের পর্যাপ্ত সাহায্য-সহায়তা ছাড়াও বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সোভিয়েত ইউনিয়ন সব রকম সহায়তা করে। বিশেষত স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বন্দরের মাইন ও ডুবন্ত জাহাজ অপসারণ এবং চট্টগ্রাম বন্দর সচল করতে সোভিয়েত নৌবহরের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের ফলে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, যন্ত্রপাতি ও পণ্য আমদানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে বঙ্গবন্ধু ক্রেমলিনে অবস্থান করেন, যা একটি বিরল মর্যাদার বিষয়। এর আগে শুধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সফরের সময়ে এ মর্যাদা দেয়া হয়। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কয়েক দফা আলোচনায় পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও দুই নেতা বহু আন্তর্জাতিক বিষয়ে কথা বলেন। পরে বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সুপ্রিম প্রেসিডিয়ামের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস পদগর্নির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ব্রেজনেভও একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিদাতা শেখ মুজিবকে দেখার জন্য সোভিয়েত জনগণ ও পলিটব্যুরোর সদস্যরা যেমন আগ্রহী ছিলেন, শীর্ষ নেতারাও তাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। বঙ্গবন্ধুর মস্কো সফরের সময় স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তিতে বাংলাদেশে নির্মীয়মাণ সোভিয়েত প্রকল্প ছাড়াও কিছু নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হয়।
বঙ্গবন্ধুর সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বড় সাফল্য হচ্ছে দ্রুত শতাধিক দেশের স্বীকৃতি পাওয়া, পাকিস্তানে আটক বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক লোকদের ফিরিয়ে আনা, আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা ও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ।
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের স্বীকৃতি ও ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ লাভ বঙ্গবন্ধুর উদার কূটনীতির এক বিরাট সাফল্য। এ ঘটনার পর একই বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগদানের জন্য ২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু নিউইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর তথ্যবহুল, দীর্ঘ ও সংগ্রামী ভাষণ বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুহুর্মুহু করতালিতে অধিবেশন কক্ষ মুখরিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত, বন্যা ও দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশকে সর্বতোভাবে আর্থিক সহায়তা দেয়ার জন্য তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে আবেদন জানান।
বঙ্গবন্ধু নিজস্ব সমস্যা ছাড়াও আন্তর্জাতিক শান্তি, সমানাধিকার, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সংকট, বিভিন্ন দেশের (যেমন ফিলিস্তিন, জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, কম্বোডিয়া প্রভৃতি) নিপীড়িত মানুষের ন্যায়সংগত স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং বিশ্বে একটি ন্যায়সংগত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে আলোকপাত করেন এবং এসব বিষয়ে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যোগদান উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে ১ অক্টোবর ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতের আয়োজন করা হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড বঙ্গবন্ধুকে শীতল ও আন্তরিকতাহীন অভ্যর্থনা জানান। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী আলোচনা যতক্ষণ চলার কথা ছিল, মিস্টার ফোর্ড এর আগেই আলোচনা শেষ করে দেন। এছাড়া সেক্রেটারি অব স্টেট ড. হেনরি কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করেননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এরূপ আচরণে বঙ্গবন্ধু অপমানিত বোধ করেন এবং মর্মাহত হন। এর কয়েক সপ্তাহ আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ব্যঙ্গোক্তি করে বলেছিলেন, ‘Bangladesh is an international basket Case (তলাবিহীন ঝুড়ি)’—এ তাচ্ছিল্যপূর্ণ বক্রোক্তিও বঙ্গবন্ধুকে আঘাত দিয়েছিল। সেজন্য বঙ্গবন্ধু ওয়াশিংটনে বসেই এ বক্রোক্তির জবাব দিয়েছিলেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ বাংলাদেশকে international basket Case বলে উপহাস করেন। কিন্তু বাংলাদেশ basket Case নয়। ২০০ বছর ধরে বাংলাদেশের সম্পদ লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, ম্যানচেস্টার, করাচি, ইসলামাবাদের। আজও বাংলাদেশে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাব বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।’ পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়ই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি হয়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে যান। সেখানে তার সঙ্গে বিভিন্ন জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সাক্ষাৎ হয়। এর মধ্য দিয়ে তিনি সেসব দেশের সঙ্গে হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বছরখানেক বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল ছিল। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন শুধু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে দেশের পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য পাওয়া যাবে না। তাই পর্যায়ক্রমে বঙ্গবন্ধু পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্যভুক্ত দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সঙ্গেও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। সে কারণে ১৯৭৪ সালের বন্যা, দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সহায়তার জন্য এবং দেশ পুনর্গঠনের জন্য বহু দেশ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে।
ঋণ ও সাহায্যের উৎস হিসেবে জাপান বঙ্গবন্ধুর সময় থেকেই বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু জাপান সফর করেন। তার এ সফরের সময়েই যমুনা সেতু প্রকল্পে জাপানি সহায়তা সম্পর্কে প্রাথমিক আলোচনা হয়। তাছাড়া জাপান সরকারি উন্নয়ন সহায়তা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রকল্প ঋণ সাহায্য প্রদান ওই সময় থেকেই শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী ছিলেন। চীন বঙ্গবন্ধুর সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলেও চীনের দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের প্রতি অনুকূল ও নমনীয় হয়ে আসে। ১৯৭৪ সালে চীনের রেড ক্রসের একটি টিম বাংলাদেশে আসে এবং বন্যার্তদের জন্য সাহায্য হিসেবে ১ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন করে। ১৯৭৫ সালের মে মাসে চীন-বাংলাদেশ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিলম্বে হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, যা বঙ্গবন্ধু সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যের অনন্য উদাহরণ।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন বঙ্গবন্ধুর সরকারের পররাষ্ট্রনীতির আরো একটি বিরাট সাফল্য। ১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বরে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন চলাকালে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে তত্পর ছিলেন। সৌদি বাদশা ফয়সাল, লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপের পর এসব দেশ বাংলাদেশের প্রতি তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরবদের পক্ষ অবলম্বন এবং চিকিৎসক দল ও চা পাঠানোর ফলে মিসর বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে যায়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রভৃতি দেশ সফর করে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর মধ্যপ্রাচ্যমুখী কূটনীতির মাধ্যমেই ওইসব দেশে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি শুরু হয়।
দায়িত্ব গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু যেমন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন দেশ সফর করেন, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের গভীরতা প্রদর্শন করেন। এদের মধ্যে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারে বুমেদিন অন্যতম। প্রেসিডেন্ট বুমেদিন বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বের বিষয়েও বঙ্গবন্ধু সচেতন ছিলেন। ১৯৭৪-এর ৪ মার্চ কুমিল্লার দাউদকান্দিতে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ উপমহাদেশে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলংকা—আমরা শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আমরা কারো সঙ্গে কোনো বিবাদে লিপ্ত হতে চাই না। আমরা আত্মমর্যাদা নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে একে অপরের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে চাই। আমাদের ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করুক তা আমি চাই না, আমরা অপরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না।’
পরবর্তীকালে ‘সার্ক’ নামে যে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা গড়ে ওঠে, তার প্রাথমিক ইঙ্গিত বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে ছিল।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর এলাকা ছিল ভারত। ভারত আমাদের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে সর্বতোভাবে সাহায্য সহায়তা করেছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যেও আমাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বেশি। সেজন্য প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চেষ্টা করেছেন। ফলে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় কোনো কোনো মহল সমালোচনা করেছে যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারত-সোভিয়েত বলয় দ্বারা প্রভাবিত। এটি যে একেবারে ভ্রান্ত মতবাদ তা বঙ্গবন্ধু তার কর্মের দ্বারা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তিনি দিল্লি হয়ে এসেছেন। এটি তার পক্ষে ছিল সম্মানেরও। কিন্তু তিনি দিল্লি থেকে ঢাকায় আসার জন্য ভারতীয় বিশেষ বিমানে ভ্রমণের আবেদন কৌশলে প্রত্যাখ্যান করেন। তাছাড়া কলকাতা ভ্রমণ বাদ দিয়ে তিনি সরাসরি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যোগদান করেছিলেন পাকিস্তানের ‘স্বীকৃতি’ আদায় করে। ভারতের এবং তাজউদ্দীনসহ মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি একক সিদ্ধান্তে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাহস, ব্যক্তিত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো নতজানু নীতি বা লেজুড়বৃত্তির স্থান ছিল না।
ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনা ও নেগোসিয়েশনেও নিজ স্বার্থ রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর শক্ত অবস্থান লক্ষ করা গেছে। ১৯৭৪ সালে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল ও সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় কিছু অতিরিক্ত ভূমি ছেড়ে দেয়ার জন্য তিনি ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ও শক্ত ভূমিকার কারণেই ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফারাক্কা বাঁধসংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্তানুসারে শুষ্ক মৌসুম, অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাসে ভারত ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করবে। আর বাংলাদেশ পাবে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি। এ চুক্তির ওপর ভিত্তি করে পরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে ফারাক্কার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
তত্কালীন ‘শত্রুরাষ্ট্র’ পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু যে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন, তাও নিজ স্বার্থে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, ‘কেউই চিরবন্ধু যেমন নয়, তেমনি চিরশত্রুও নয়।’ বাংলাদেশের স্বার্থ ছিল পাকিস্তান ও এর মিত্রদের স্বীকৃতি, বাঙালি প্রত্যাবাসন, সম্পদের হিস্যা ও বাংলাদেশ থেকে অবাঙালিদের ফেরত পাঠানো; যদিও সব বিষয়ে সমস্যার সুরাহা হয়নি।
অদ্যাবধি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সামগ্রিক মূল্যায়নে যে সত্যটি প্রতিভাত হয় তা হলো, দেশের পররাষ্ট্রনীতির মৌল কাঠামো ও ভিত্তি বঙ্গবন্ধুর সময়ই রচিত হয়েছিল। পররাষ্ট্রনীতির এ মৌল ভিত্তি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানেই ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে লিপিবদ্ধ করে গেছেন, যা আজও আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। সাংবিধানিক বিধানের সঙ্গে ব্যক্তি মুজিবের ইমেজ ১৯৭২-৭৫ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দিয়েছিল।
লেখক : মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া – সাবেক সিনিয়র সচিব ; এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।