বামপন্থি শিক্ষার্থীরা মাঠে নামবার পর ছাত্রদল এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে মাঠে নামলেও পুলিশের বাঁধার মুখে পড়বার পর তারা মাঠ ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সিদ্ধান্তে তারা এখনো স্থির রয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মুশতাকের মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ে তারা কথা বললেও, এ বিষয়টা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন গড়ে তোলবার সামর্থ্য বা ইচ্ছা এর কোনটাই যে তাদের নেই, মাঠ থেকে সরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা সেটা স্পষ্ট করেছে ।
সংসদে তৃতীয় স্থানের অধিকারী হলেও অন্য যে কোনও বিবেচনায় বিএনপি এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি নেবার আগে তাদের তাকিয়ে থাকতে হয় ১ শতাংশ জনসমর্থনের অধিকারী বামপন্থি বা কয়েক শতাংশ জনসমর্থনের অধিকারী “ইসলামপন্থি”দের দিকে।
বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ তার “চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা ১৯৮৩-১৯৯০” বইয়ে লিখেছেন (পৃষ্ঠা- ২৯৮), “বিএনপি এখনো একটি রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়নি। এর অনেক সমস্যা। এটি কোনদিন একটি সংগ্রামী রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে কিনা বলা কঠিন।“
সংগ্রামী রাজনীতির চেয়ে আরামদায়ক ঘরোয়া রাজনীতি বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নির্ভর রাজনীতিতে বিএনপি যে অধিক স্বাছন্দ্য বোধ করে, এ বিষয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের খুব বেশি দ্বিমত করবার বোধহয় অবকাশ নেই।
জামায়াতসহ বিভিন্ন “ইসলামপন্থি” দলের সাথে গাঁটছাড়া বাধা বিএনপি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মুশতাকের মৃত্যু ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কিছুটা সরব হবার চেষ্টা করলেও এ বিষয়ে পুরো নীরব রয়েছে সমস্ত ঘরানার “ইসলামপন্থি” দলগুলো।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মিডিয়া ওয়াচডগ বডি আর্টিকেল ১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৯৮টি মামলায় ৪৫৭ জনকে বিচারের আওতায় আনা ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেখা গেছে, যারা এ আইনে গ্রেপ্তার বা বিচারের আওতায় এসেছেন তাদের বড় অংশই রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে বাম বা সেক্যুলার ধারার।
এখন পর্যন্ত “ইসলামপন্থায়” বিশ্বাসী কোন রাজনৈতিক কর্মী এ ধারায় গ্রেপ্তার বা বিচারের সম্মুখীন হননি মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশ্যে নানা কটূক্তি করা সত্ত্বেও। “ইসলামপন্থি” দলগুলো সেক্যুলার এবং বামপন্থিদের তাদের মূল রাজনৈতিক শত্রু মনে করে।
বামপন্থিদের তারা নাস্তিক এবং সেক্যুলারদের প্রায় নাস্তিক মনে করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেহেতু তারাই মূলত গ্রেপ্তার এবং বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন,তাই “ইসলামপন্থিরা” তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের সহায়ক হিসাবেই এ আইনকে দেখছেন।
এ আইনটি একই সাথে “ইসলামপন্থার” রাজনীতির সাথে মতাদর্শিকভাবেও সাংঘর্ষিক নয়। এর আগে তারা দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটেনের ব্লাসফেমি আইনের অনুকরণে আইন চেয়ে আসছিল। ওই সময় তাদেরকে দুটো সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রথমটি হল- “ইসলামপন্থার” রাজনীতি করেও তারা খ্রিস্টানদের আইন চাচ্ছে। দ্বিতীয়টি হল- তারা পশ্চিমা সভ্যতার বিরুদ্ধে কথা বললেও সাবেক উপনিবেশিক প্রভুদের করা সেই পশ্চিমা আইনই বাংলাদেশে চাচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রতি তাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থনের ফলে তাদেরকে এ দুটো সমালোচনার কোনটিরই মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। অর্থাৎ, তাদেরকে কোন মতাদর্শিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে না।
মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয় নিয়েও “ইসলামপন্থিদের” কোন আদর্শিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে না। কেননা এ বিষয়ে কোন প্রকার রাখঢাক না করে তারা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছে। “ইসলামপন্থার” রাজনীতির সাথে সাংঘর্ষিক যেকোনও মতবাদ বা সংস্কৃতিকে তারা “ইসলাম বিরোধী” মনে করেন। “ইসলাম বিরোধী” যেকোন কিছু তারা রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে নিষিদ্ধ করবার পক্ষপাতী।
“ইসলামপন্থি”দলের নেতা কর্মীরা নানা সময়ে আরো স্পষ্ট করেছেন, মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতায় তারা বিশ্বাস করেন না। মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা তাদের কাছে একটি পশ্চিমা ধারণা, যেটি বিরাজমান থাকলে সমাজে ফিতনা বা নৈরাজ্য তৈরি হবে। তারা মত প্রকাশের ততটুকু স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, যেটি তাদের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিকাশের সহায়ক।
যে সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং সংগঠন তাদের রাজনীতি এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করে না, অথবা তার বিরোধী, তাদেরকে “ইসলামপন্থি” দলগুলো কোন স্পেস দিতে রাজি নয়, নানা বক্তব্যে এ বিষয়টিও তারা স্পষ্ট করেছে। তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের তারা চিহ্নিত করে নাস্তিক, বামপন্থি, সেক্যুলার, “রামপন্থি” (ভারতপন্থি), ইহুদীবাদী, ইঙ্গ-মার্কিনের দালাল এ সমস্ত ক্যাটাগরিতে। এদের কারোরই রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার বা রাজনীতি করার অধিকার থাকা উচিৎ নয় বলে তারা মনে করেন। কেননা, তাদের মতে এরা সবাই ধর্ম, দেশ এবং জনগণের শত্রু।
ইরান, আফগানিস্তানসহ ইরাক-সিরিয়ার যে অঞ্চল “ইসলামপন্থি” দল বা সশস্ত্র সংগঠনের অধীনে ছিল বা আছে, তার কোন জায়গাতেই তারা তাদের বিরোধীদের রাজনৈতিক স্পেস বা মত প্রকাশের অধিকার দেয়নি। বাংলাদেশের কোন “ইসলামপন্থি” দলই সে সমস্ত জায়গায় বিরোধীদের মত প্রকাশ এবং রাজনীতি করবার স্বাধীনতা থাকা উচিৎ বলে কখনো বিবৃতি দেয়নি বা সভা-সমাবেশ করেনি। বরং সেখানকার “ইসলামপন্থিদের” সমস্ত কার্যক্রমকে তারা নানাভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে।
“ইসলামপন্থি” রাজনীতির উৎপত্তি এবং বিকাশ ঘটেছে বামপন্থার রাজনীতির বিরোধিতা করবার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু একই সাথে তারা কমিউনিস্ট রাজনীতি বিশেষত স্তালিনবাদী কমিউনিস্ট রাজনীতির সাংগঠনিক নীতি, কৌশল ইত্যাদি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।
স্তালিনবাদী রাজনীতির মূল কথা হচ্ছে, যারা কমিউনিস্ট নয়, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তাদের কোন স্পেস থাকা উচিৎ নয়। কোন না কোন ক্যাটাগরিতে তারা “প্রতিক্রিয়াশীল” এবং সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের প্রধান প্রতিবন্ধক। তাই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মূল শর্ত হল তাদেরকে নির্মূল করা। নোয়াম চমস্কিসহ অনেক চিন্তক অবশ্য মনে করেন, লেনিন নিজেই এ ধরনের রাজনীতির পথ এবং ভিত্তি স্থাপন করেছেন।
সময়ের সাথে সাথে কিছু ব্যতিক্রম বাদে বিশ্বের বাম ধারার প্রায় সব দলই এ স্তালিনবাদী রাজনীতি থেকে সরে আসলেও “ইসলামপন্থি” দলগুলো নিজেদেরকে এ অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসার কোন উদ্যোগ নেয়নি। তারা মনে করে তাঁদের রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূল করা ছাড়া “ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। বহুত্ববাদিতা “ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়। ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে তারা দেখছে তাদের রাজনীতিকে এগিয়ে নেবার একটি সহায়ক আইন হিসেবে।
‘ইসলামপন্থি” দলগুলোর বিপরীতে বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ বামপন্থি দলগুলো সাবেক বামপন্থার জায়গা থেকে সরে এসে মূলত লিবারেল বা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ধারার দলে পরিণত হয়েছে। তারা সবাই মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে যতটা সম্ভব অবারিত করবার পক্ষপাতি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে বাম দলগুলোর মাঝে এ ধারা জোরদার হয়েছে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকবার সময় থেকেই পশ্চিম ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের বাম দলগুলো এ ধারার ছিল। সোভিয়েত পতন পরবর্তীতে বিশ্বের অধিকাংশ বাম দলই এখন এ ধারা অনুসরণ করছে।
এ ধারার বাম আন্দোলনকে একসময় ইউরো কমিউনিজম, নিউ লেফট, নিউ মার্কসিজম ইত্যাদি নানা ধারায় অভিহিত করা হত। এ আন্দোলনের সার কথা হল গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটান সম্ভব এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের চেয়ে অধিক গণতান্ত্রিক।
তবে অনেকে মনে করেন নিউ লেফট, নিউ মার্কসিজম ইত্যাদি বলা হলেও আসলে এটা হচ্ছে মার্কসের মূল দর্শন বা বীক্ষার কাছে ফিরে যাওয়া। কেননা মার্কসবাদের সারবত্তা হচ্ছে শুধু ধনিক শ্রেণি নয়, সকল মানুষ যাতে সমভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, এমন সমাজ কাঠামো গড়ে তোলা। সে কাঠামো শুধু এক ধরণের নয়, বরং সব ধরণের সংস্কৃতির চর্চা এবং বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
তাই তত্ত্বগতভাবে বামপন্থি মতবাদ একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক মতবাদ এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সহাবস্থান দেখতে আগ্রহী বা বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। বস্তুত এ বিষয়টি “ইসলামপন্থার” রাজনীতির সাথে বামপন্থার রাজনীতির গুণগত পার্থক্যের জায়গা নির্দেশ করে। আরেকটি গুণগত পার্থক্য হল, সকল ঘরানার বাম দল এবং সংগঠনগুলো চর্চা ও মতাদর্শগত দিক থেকে সেক্যুলার।
তাদের রাজনৈতিক দলের অবস্থান যাই হোক, বাংলাদেশেও অধিকাংশ তরুণ বাম রাজনৈতিক কর্মী মননগতভাবে ইউরো কমিউনিজম বা নিউ লেফটের চিন্তাধারাকেই ধারণ করে। তবে পশ্চিমের সাথে তাঁদের যে পার্থক্যের জায়গা রয়েছে সেটা হল, তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে কোন স্পেস দিতে রাজি নয়। অধিকাংশ বাম কর্মী রাষ্ট্র শক্তির সাহায়তায় রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করবার পক্ষপাতী।
মুশতাক মারা যাবার পর বাম ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা মুশতাকের গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে। একে কেন্দ্র করে তাদের যে রাজনৈতিক অবস্থান অর্থাৎ, ধর্ম এবং রাজনীতি দুটো আলাদা ক্ষেত্র এবং এ দুটোকে কোন ভাবেই এক করা যাবে না, তা প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এ চ্যালেঞ্জ মূলত আসে বিভিন্ন বাম সংগঠনের কিছু কর্মীর কাছ থেকে।
এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হতচকিত জানাজা আয়োজনকারী বাম কর্মীরা বলেন, এটা ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক কর্মসূচি। কিন্তু এতে আরো বেশি গোল বাঁধে। কিছু অমুসলিম বাম কর্মী প্রশ্ন তোলেন, এটি রাজনৈতিক কর্মসূচি হলে তারা সেই কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিতে পারবেন কিনা।
বঙ্গবন্ধু যখন সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশকে সেক্যুলার রাষ্ট্র ঘোষণা করেন তখন তাকেও এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। বদরুদ্দীন উমরসহ যারা অতি বাম হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তারা প্রশ্ন তোলেন রাষ্ট্র সেক্যুলার হলে বঙ্গবন্ধু কেন জুম্মার নামাজ বা জানাজার নামাজ আদায় করবেন।
এ ধরনের প্রশ্ন তুলে এ বামপন্থিরা মূলত “ইসলামপন্থি” এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকেই তখন সহায়তা করেছিলেন। সেক্যুলার মতবাদ সম্পর্কে এ বামপন্থিদের ধারণাও ছিল তাদেরই মত। অর্থাৎ, “ইসলামপন্থিদের” মত তারাও মনে করতেন সেক্যুলারিজম মানে হচ্ছে নাস্তিকতাবাদ। এতে অবশ্য অবাক হবার কিছু নেই। “বামপন্থার বাল্য ব্যাধি” গ্রন্থে লেনিন দেখিয়েছেন, অতি বামপন্থিরা কেন আসলে দক্ষিণপন্থি এবং কেন তারা দক্ষিণপন্থার অতি নিকটে অবস্থান করে।
বর্তমানে বাংলাদেশের বামপন্থিদের বড় অংশটিই সেক্যুলারিজম এবং ধর্মের সম্পর্কের বিষয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশায় রয়েছেন। এ দুটি বিষয়ের সম্পর্কের রূপটা কেমন হওয়া উচিৎ, এ বিষয়টা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়।
“ইসলামপন্থি” এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের ক্রমাগত প্রচারণার ফলে বাম কর্মীদের অনেকেই সেক্যুলারিজম এবং নাস্তিকতাকে এক সাথে গুলিয়ে ফেলেন। ফলে, তারা মনে করেন বাম রাজনৈতিক দলের সদস্য হলে তাদের বোধহয় পাবলিক প্লেসে কোন ধর্মকর্ম করা উচিৎ নয়।
সেক্যুলার রাষ্ট্রের মূল বিষয়টা হল রাষ্ট্র ধর্মমত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ধর্ম পালনের সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে। সকল ধর্মকেই রাষ্ট্র সমান ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করবে। রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্মের পরিচয়ে পরিচিত হবে না বা শুধু কোন একটি ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। আবার কেউ যদি কোন ধর্ম পালন করতে না চায়, সেক্যুলার রাষ্ট্রে তার সে স্বাধীনতাও থাকবে। রাষ্ট্র তাকে কোন বিশেষ ধর্ম পালনে বাধ্য করবে না। সেক্যুলার রাষ্ট্রে কোন ব্যক্তির ধর্ম পরিচয় তার চাকরী, ব্যবসা বাণিজ্য বা রাজনীতি করবার অধিকারে প্রতিবন্ধক হবে না।
কিন্তু তার মানে একই সাথে এই নয় যে, রাষ্ট্র এবং সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পাবলিক প্লেসে নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালন করবেন না বা করতে পারবেন না। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, সেক্যুলার রাষ্ট্রে কোন সরকারি অফিসে কেউ চাইলে যেমন নামাজ আদায় বা মিলাদের আয়োজন করতে পারবেন, আবার অন্য ধর্মালম্বীরা চাইলে, তাদের ধর্মের বিধি অনুযায়ী প্রার্থনা করতে পারবেন। প্রার্থনা করবার বা না করবার বিষয়ে সবার সমান স্বাধীনতা এবং অধিকার থাকবে। এ সহজ বিষয়টা বাংলাদেশের বামপন্থি এবং সেক্যুলার মতাদর্শে বিশ্বাসীরা গত পঞ্চাশ বছরে জনগণের বড় একটি অংশকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে সব ধর্মের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে সেক্যুলার রাষ্ট্র গড়ার সংগ্রামে রত আছেন। সকল মানুষের ধর্ম পালনের সমান স্বাধীনতা নিশ্চিত করবার জন্য তারা ১৯৪৭ সাল থেকে লড়াই করে আসছেন।
এখন এ লড়াইয়ে তারা কতটা আন্তরিক সেটা নির্ভর করছে, তাদের নেতাকর্মীদের নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালনের স্বাধীনতা বা পরিবেশ তাঁরা নিশ্চিত করতে পারছেন কিনা, তার উপর। আগামীদিনের সেক্যুলার বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে তাঁদের ভূমিকা- এ বিষয়টার সাথে যুক্ত।
ধর্মভিত্তিক দলগুলির বিপরীতে বাম রাজনৈতিক দলগুলি কোন বিশেষ ধর্মে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসীদের দল নয়। ধর্মভিত্তিক দলগুলি শুধু একটি ধর্মে বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়। নারীদেরকে দলের নেতৃত্ব থেকে দূরে রাখতে চায়। অপরদিকে, বামপন্থিরা ধর্মে বিশ্বাসী/অবিশ্বাসী সকল নারী/পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়।
এখানে উল্লেখ্য যে, ধর্মীয় বিধিবিধান পালন আর ধর্মকে রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার, এ দুটো বিষয় এক নয়।ধর্ম ভিত্তিক দলগুলি ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের মাধ্যম হিসেবে।
অপরদিকে, বাম রাজনৈতিক দলগুলি সংগ্রাম করছে সকল মানুষের রুটি, রুজির অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি সবার ধর্ম পালনের সম অধিকার নিশ্চিত করবার জন্য। বস্তুত এ বিষয়টি সঠিক ভাবে জনগণকে বোঝাতে পারবার ব্যর্থতাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের পৌঁছাতে না পারবার মূল কারণ।
মুশতাক যেহেতু ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, তাই তাকে বিদায় জানাবার জন্য ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী বাম কর্মীরা জানাজা পড়বেন এটাই স্বাভাবিক। এটি রাজনৈতিক কর্মসূচি হলেও এর চেয়ে বড় কথা এটা একই সাথে ধর্মীয় কর্মসূচিও।
বাম রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে সে ধর্মীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বা আয়োজনে তাদের কোন সমস্যা হবার কথা নয়। যেমন হয়নি কমরেড মণি সিংহের হিন্দু ধর্মীয় মতে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান বা মোহাম্মদ ফরহাদের বিশাল জানাজার নামাজের আয়োজনের।
মণি সিংহ বা ফরহাদ কেউই নাস্তিক ছিলেন না। তাদের জীবৎকালেও নানা সময়ে তাদেরকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বা ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করতে দেখা গেছে।
কমিউনিস্ট বা বাম রাজনৈতিক দলগুলির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কোন ধর্মীয় মতের পক্ষে বা বিপক্ষে আন্দোলন বা জনমত গড়ে তোলা নয়। তাদের লক্ষ্য রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করে এমন রাষ্ট্র গড়ে তোলা, যা মানুষের মৌলিক মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করবে। তাদের মতে সবার গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চয়তার পূর্বশর্ত হচ্ছে সব মানুষের অর্থনৈতিক সমতা বা সাম্যতা নিশ্চিত করা—যাতে সমাজের বিদ্যমান ধনী-দরিদ্র বৈষম্য দূর হয়।
শ্রেণি বিলোপের মাধ্যমে এ বৈষম্য দূর হলেই একটি রাষ্ট্র প্রকৃত গণতান্ত্রিক হয়ে উঠবে বলে বামপন্থিরা মনে করেন। আর এ ধরনের একটি রাষ্ট্র যাতে প্রতিষ্ঠা হতে না পারে তার জন্য শাসক গোষ্ঠী ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত এবং বিভক্ত করে বা মার্কসের ভাষায় সমাজ সম্পর্কে ভ্রান্ত চেতনা বা False consciousness তৈরি করে। এর মূল উদ্দেশ্য হল, তাদের জুলুম এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না হয়ে প্রতিবাদের লক্ষ্যবস্তু যাতে ভিন্ন কিছু হয়। বামপন্থিদের লড়াইটা ধর্মের এ অপব্যবহারের বিরুদ্ধে।
পাকিস্তান আমলের মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য ছিল সকল মানুষের ধর্ম পালনের সমঅধিকার নিশ্চিত করা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল লক্ষ্য এ সেক্যুলার বাংলাদেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশে যে বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরে চলছে সেটি হল সেক্যুলার রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক দলের ভূমিকা এবং স্পেস নিয়ে। উল্লেখ্য, পার্শ্ববর্তী ভারত, তুরস্ক সহ কোন সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করা হয়নি। সেসব দেশে এটা মনে করা হয় যে, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করলে, যে দলই ক্ষমতায় আসুক, জনগণ না চাইলে পরবর্তী নির্বাচনে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে।
আগামীদিনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে গণমানুষের ভাষায় কথা বলে, তাদের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁরা নিজেদের কতটুকু নিয়োজিত রাখতে পারবে তার উপর।
লেখক- সাঈদ ইফতেখার আহমেদ, শিক্ষক ও গবেষক।