ধানের ফলনের অগ্রগতি অর্জনে পরিবর্তিত আবহাওয়া ও জলবায়ু, কৃষিতাত্ত্বিক প্রযুক্তি এবং জিনগত প্রযুক্তি- এই তিনটি বিষয়ের পৃথক অবদান রয়েছে। ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স প্রকাশিত এক গবেষণার প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী, দশকীয় জলবায়ু প্রবণতার কারণে ফলন বৃদ্ধি হচ্ছে ৪৮ শতাংশ, কৃষিতাত্ত্বিক উন্নতির জন্য ৩৯ শতাংশ এবং মাত্র ১৩ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি হচ্ছে জিনগত উন্নতির কারণে। বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং জলবায়ুর মাত্রা ও ধরন সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে। এ অবস্থায় জিনগত উন্নতি ফলনের অগ্রগতিকে মন্থর করে দিলে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়বে। কাজেই আবহাওয়ার এই তারতম্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন কৃষিতাত্ত্বিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন, সম্প্রসারণ এবং এর প্রয়োগের মাধ্যমে ধান উৎপাদন চালিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের ধান উৎপাদন টেকসই করতে ওয়েদার স্মার্ট প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ওয়েদার স্মার্ট প্রযুক্তিতে প্রতি মৌসুমের শুরুতে অঞ্চলভিত্তিক মৌসুমি পূর্বাভাস বা সিজনাল ফোরকাস্ট দেওয়া হবে, যেটি ব্যবহার করে ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় কৌশলগত সিদ্ধান্ত আগাম (বপনের সময় নির্ধারণ, জাত নির্বাচন ইত্যাদি) নেওয়া সম্ভব হবে। একই সঙ্গে মৌসুমি পূর্বাভাস যাচাইয়ের জন্য উপমৌসুমি পূর্বাভাস দেওয়া হবে, যার মাধ্যমে প্রাক-কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে। তবে ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী মধ্যমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাস, যা পাঁচ-সাত দিনের জন্য দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে উপমৌসুমি পূর্বাভাসের যাচাই হবে এবং সাপ্তাহিক ভিত্তিতে কৌশলগত সিদ্ধান্ত, যেমন জমি তৈরি ও চারা রোপণের সঠিক সময়, সার বা কীটনাশক প্রয়োগের সময়, সেচ ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই ও পোকামাকড় সম্পর্কে সতর্কতা ইত্যাদি সিদ্ধান্ত দক্ষতার সঙ্গে গ্রহণ করা সম্ভব হবে। সব মৌসুমে এসব কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে ওয়েদার স্মার্ট প্রযুক্তির বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সমন্বিত এই উদ্যোগের নাম হবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসভিত্তিক ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, যা ইন্টিগ্রেটেড রাইস অ্যাডভাইজরি সিস্টেমের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। এ সিস্টেমে পূর্বাভাসের ডাটা প্রক্রিয়াকরণ, মূল্যায়ন, কৃষকদের আবহাওয়ার পূর্বাভাসভিত্তিক ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও পরামর্শ সেবা প্রস্তুত এবং প্রচার করা হবে। সংশ্নিষ্ট বিভাগগুলোর সমন্বয়ে এ প্ল্যাটফর্মকে কার্যকর করে তুলতে হবে; যেখানে কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উচ্চ সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে। এ সমন্বিত ব্যবস্থায় আবহাওয়া অধিদপ্তর মৌসুমি পূর্বাভাস ও উপমৌসুমি পূর্বাভাস এবং প্রতি সপ্তাহে মধ্যমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাসের সঙ্গে যে কোনো ধরনের বিরূপ আবহাওয়া সম্পর্কে আগাম পূর্বাভাস দেবে। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কাজ হবে আগাম এবং আকস্মিক বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সেই পূর্বাভাস অনুসারে, ফসল-আবহাওয়ার বিভিন্ন নিয়ামকের সম্পর্ককে ধানের বৃদ্ধি পর্যায় অনুযায়ী বিবেচনায় নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক কৃষি পরামর্শ অথবা বুলেটিন তৈরি করবে। একই সঙ্গে আইআরএএস প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কৃষকদের কাছে ভয়েস এসএমএসের মাধ্যমে সরাসরি পৌঁছে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও সেই কৃষি পরামর্শ সংশ্নিষ্ট অঞ্চলের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ, কৃষকের মাঠে ওই কৃষি পরামর্শ বাস্তবায়ন মনিটরিং এবং কৃষকদের কাছ থেকে ফিডব্যাক গ্রহণ করবে। একটি কল সেন্টার নাম্বার থাকবে, প্রয়োজনে যে কোনো কৃষক কৃষি পরামর্শ সম্পর্কে অথবা চাষাবাদ সংক্রান্ত যে কোনো ব্যাপারে সেই নাম্বারে যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁদের সমস্যা সমাধান করতে পারবেন। তা ছাড়া কৃষকদেরও এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে এবং আবহাওয়ার তথ্য ও কৃষি পরামর্শ ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তাঁদের অবশ্যই আবহাওয়া বিষয়ে জানতে হবে এবং এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। সার্বিক ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।
ব্রি’র এগ্রোমেট ল্যাবের গবেষণা অনুযায়ী, কৃষকদের প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতির তুলনায় ওয়েদার স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতি হেক্টরে গড়ে প্রায় আধা টন ফলন বেশি পাওয়া সম্ভব; উৎপাদন খরচ ১৫ শতাংশ হ্রাস এবং মোট আয় প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এই পদ্ধতিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের তথ্যকে কাজে লাগিয়ে সেচের পানি, শ্রমশক্তি, জ্বালানি, সার, সেচ, আগাছানাশক, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকের পরিমিত ও সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারই উৎপাদন খরচ হ্রাসের মূল কারণ। একই সঙ্গে কৃষি উপকরণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং রাসায়নিকের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশদূষণ কমাতে সহায়ক হবে।
এ ব্যবস্থা বাংলাদেশের ধান চাষে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সক্ষম। সম্প্রতি ব্রি উদ্ভাবিত ওয়েদার স্মার্ট প্রযুক্তি ডিজিটাল বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড ২০২২ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
লেখক : নিয়াজ মো. ফারহাত রহমান – প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগ এবং কো-অর্ডিনেটর, এগ্রোমেট ল্যাব, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)