বাংলা একাডেমি ‘আদর্শ’ নামের একটি প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দিচ্ছে না বলে শুনলাম। স্টল না দেবার পেছনে বাংলা একাডেমি যুক্তি দিয়েছে এই বলে যে, এই প্রকাশনী তাঁদের নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক বই প্রকাশ করেছে। আমার দুঃখ একটা জায়গাতেই। আমাদের ইন্সটিটিউটগুলো কিংবা আমাদের প্রশাসনের কোনো একটি অংশ যখন কোনো বিষয়ে ব্যখ্যা দিতে যান, তাঁরা সেটি স্পষ্টভাবে, স্মার্টলি দেন না। কেন দেন না কে জানে। বাংলা একাডেমি ফাহাম আব্দুস সালামের যেই বইটি নিয়ে আপত্তি করেছে সেটা শুধু সঠিক কাজই করেছে তা নয় বরং গত এক যুগে যে কয়টি মনে রাখার মতো কাজ করেছে সেগুলোর একটি। এই বিষয়ে লাইন ও শব্দ ধরে ধরে একজন মুখপাত্র যদি বলতেন তাহলে একটা কাজের কাজ হতো। কিন্তু বাংলা একাডেমি তা করেনি ফলে একধরনের ধোঁয়াশা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
ফাহাম বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামাতা। আমার কাছে যেই তথ্য আছে, সে তথ্য অনুযায়ী ফাহাম জাতিগতভাবে বিহারী। কিন্তু ফাহামের এই রাজনৈতিক এবং জাতিগত অবস্থান আমার কাছে কখনোই বিচার্য নয় বা ছিলোও না যতক্ষণ পর্যন্ত তার ভাবনাগুলো আমি জানতে পারিনি। ফাহামের পুরো বইটা জুড়ে বাঙালি বিদ্বেষ। বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আমরা কেন পাকিস্তান ভাঙলাম। লাভ কি হলো, বাঙালি খামাখাই মুক্তিযুদ্ধে গেছে, বাঙালি মানুষ হয়নি ইত্যাদি। পুরোটা বইজুড়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে কটাক্ষ, খিস্তি, খৈওড় ছাড়া আর কিছুই নেই।
ফাহাম সবচাইতে ভয়ানক বাক্যগুলো লিখেছে গ্রন্থটির ‘‘বাঙালির বিপ্লব’ শিরোনামের একটি অধ্যায়ে। এই লেখাটা এক কথায় ভয়াবহ। এই অধ্যায়ে সে যা লিখেছে সেটির সারমর্ম দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ থেকে নিস্তার পাওয়া আসলে বিপ্লব নয় বরং আওয়ামী লীগের আদর্শ যাতে কেউ ভবিষ্যতে যাতে কল্পনাও না করতে পারে সেটির ব্যবস্থা করতে হবে এবং এটিই নাকি সত্যকারের বিপ্লব। এর মানে অনেকটা এমন যে, যারা আওয়ামী লীগের আদর্শ পছন্দ করে কিংবা ভালোবাসে, তাদের নিকেশ করে দিতে হবে। শেষ করে দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাইকে হত্যা করার পর ঘাতকের দল বাইরে এসে বলেছিলো, ‘অল আর ফিনিশড’। ফাহামের লেখার এই অংশটি অনেকটা ‘জাতিগত ক্লিনজিং’র পদ্ধতি কেমন হতে পারে সেটির পরামর্শের মতন। ভাবা যায়?
১৯৭৫ সালে বঙ্গন্ধুর ঘাতকেরা ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগের আদর্শকে চিরতরে মুছে দিতে চেয়েছিলো। আমার কাছে ঘাতক লে. কর্নেল ফারুকের গোটা পনেরো সাক্ষাৎকার রয়েছে যেগুলোর ভাষা আর ফাহামের বইয়ের ভাষা জাস্ট অদল বদল করে দেওয়া যায়। একই ভাষা। একই শব্দ। একই এপ্রোচ। একই ইচ্ছে। এই স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মুছে দেবার কথা বলছে আর সেই বই গত তিন চার বছর ধরে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই লজ্জা আসলে কার? টনক এতদিন পরে নড়েছে?
ফাহামের এই বক্তব্যগুলো বাংলাদেশের পেনালকোডের ১৫৩ (ক) কিংবা ১২৪(ক) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জাতিগত বিদ্বেষ, অরাজক পরিস্থিতি তৈরী করা, রাষ্ট্র নিয়ে মিথ্যাচার, মিথ্যে গল্প, মিথ্যা তথ্য। শুধু তাই নয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারাতেও এই বই, বইয়ের প্রকাশক, লেখক সবাইকে ধরা যায়। কিন্তু রাষ্ট্র ছাড় দিয়েছে। তা করেনি।
ফাহামের এই বইটি সমাজে ঘৃণা ছড়াবার একটা দলিল মাত্র। আমি একটা ভিডিও ব্লগ বানিয়ে এই বই নিয়ে বিস্তারিত বলবো কাল, কিন্তু তার আগে এটা জানিয়ে রাখি যদি এই বইটির কারণে আদর্শ নামের প্রকাশনীটি স্টল না পেয়ে থাকে তবে বাংলা একাডেমি অতি অবশ্যই একটা অসাধারণ কাজ করেছে। আমি নিজে একজন ক্ষুদ্র লেখক। লেখকের লেখার অধিকার এবং বলার অধিকারের ব্যাপারে আমি খুবই বিশ্বাসী। কিন্তু সেটা কতদূর পর্যন্ত? একজন লেখকের কি আদৌ অধিকার রয়েছে একটি পুরো জাতিসত্ত্বাকে নিয়ে নোংরামো করবার? ঘৃণা ছড়াবার? কিংবা…লেখকের কি আদৌ স্বাধীনতা রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আদর্শকে চিরতরে নিকেশ করবার কথা বলা বা উৎসাহ দেওয়া যেই রাজনৈতিক আদর্শের মাধ্যমে এই বাংলাদেশ পেয়েছি? যেই দলটি বঙ্গবন্ধুর, যেই দলটি কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসার দল, যেই রাজনৈতিক আদর্শের জন্য যুদ্ধ করে নিজের বিলীন হয়ে যাওয়া অস্তিত্বকে পেয়েছি সেই দলকে নিকেশ করে দেবার আহ্বান কেন এই স্বাধীন বাংলাদেশে বাজারজাত হবে, আমাকে কি কেউ বলতে পারেন?
ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদাররের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে…