দুই থেকে তিন দশকে পৃথিবীতে যে’কটি নতুন বা ইমার্জিং রোগের সাথে মানুষের পরিচয় হয়েছে তার ৭৫ শতাংশই হচ্ছে জুনুটিক ডিজিজ অর্থাৎ প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়া রোগ। হালের কোভিড-১৯ এর একটা বড় উদাহরণ। যদিও নানা প্রাণী থেকে এই ধরনের রোগগুলো ছড়াতে পারে, এদের মধ্যে বাদুরের নামটাই চলে আসে সবার আগে।
বাদুর হচ্ছে একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যা উড়তে পারে এবং এই সক্ষমতাটাই বাদুরকে জুনুসিসের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। মেরু অঞ্চল আর মরুভূমি বাদ দিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ১৪০০ প্রজাতির বাদুর।
সার্স-কোভ-২-এর মতো নিপাহ ভাইরাস হচ্ছে আরেকটি ভাইরাস যা বাদুর থেকে মানুষে ছড়ায়। ভাইরাসটি শুকর বা বাদুর দিয়ে কন্টামিনেটেড খাবারের মাধ্যমে যেমন মানুষে ছড়ায় তেমনি এটি ছড়াতে পারে মানুষ থেকে মানুষেও।
নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর হার ৫০-৭০ শতাংশ আর যা ভাবায় তা হলো অনেক বিশেষজ্ঞরই ধারণা যে, পৃথিবীতে আগামী মহামারি হতে পারে এই ভাইরাসের কারণেই।
ড. কো বিং চুয়া ১৯৯৯ সালে শুকরের শরীরে প্রথমবারের মতো নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত করেন। সেই সময় সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার শুকর খামারিদের মধ্যে এক ধরনের এনকেফালাইটিস অর্থাৎ মস্তিষ্কের প্রাণঘাতী প্রদাহ দেখা দিয়েছিল যার ফলে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের শুকর রপ্তানিশিল্প প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল।
কামপুং সুংগাই নিপাহ নামের যে গ্রামে প্রথমবারের মতো এই ভাইরাস শনাক্ত হয় সেখান থেকেই ভাইরাসের নামকরণ। বাংলাদেশে এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ২০০১ সালে, আর তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই এই দেশে নিপাহর আউটব্রেকের ঘটনা ঘটে চলেছে।
মালয়েশিয়ার এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশ-ভারতে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ শতাংশে। আর প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের একমাত্র প্রাকৃতিক রিজার্ভার হচ্ছে বাদুর।
নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির কোনো রকম কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে এই কথা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে নিপাহ রোগীর ফুসফুসে বা মস্তিষ্কে মারাত্মক প্রদাহও দেখা দিতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির শুরুতে সাধারণত জ্বর, মাথা ব্যথা, মাংস পেশীতে ব্যথা, বমি আর গলা ব্যথার মতো লক্ষণগুলো দেখা দেয়।
পরবর্তীতে ঝিমিয়ে পরা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের প্রদাহের বিভিন্ন লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে আবার ফুসফুসে সংক্রমণের লক্ষণগুলো প্রকট হতে পারে। আক্রান্ত রোগী সাধারণত ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোমায় চলে যান।
শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করার পর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ৪-১৪ দিন আর কখনো কখনো ৪৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। যারা সৌভাগ্যক্রমে নিপাহ থেকে বেঁচে যান তাদের সাধারণত কোনো স্থায়ী সমস্যা দেখা দেয় না, তবে প্রায় ২০ শতাংশ রোগীর দীর্ঘমেয়াদি নিউরোলজিক্যাল সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এখন পর্যন্ত প্রাণী বা মানুষের জন্য নিপাহর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন নেই, আর রোগের চিকিৎসা বলতে আছে শুধুই সাপোর্টিভ কেয়ার।
বাংলাদেশ আর ভারতে মূলত কাঁচা খেজুরের রস থেকে নিপাহ ছড়ায়, আর খেজুরের রসে ভাইরাস মিশে বাদুরের প্রস্রাব আর লালা থেকে।
নিপাহ নির্ণয়ের জন্য কোভিডের মতো আমাদের নির্ভর করতে হয় আর. টি-পিসিআরের উপর, তবে এলাইজার মাধ্যমেও নিপাহর এন্টিবডি শনাক্ত করা সম্ভব।
নিপাহর যেহেতু কোনো কার্যকর চিকিৎসা নেই কাজেই বাঁচতে হলে জানতে হবে কীভাবে আমরা এর থেকে দূরে থাকতে পারি। আর এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় নিয়মিত সার্ভিল্যান্স আর যখনই কোথাও এই ভাইরাসের আউটব্রেক দেখা দেয় তখন সেখানে দায়ী প্রাণী রিজার্ভার কোয়ারেন্টাইনের উপর।
খেজুর রস থেকে বাদুরকে দূরে রাখাও নিপাহ নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। এজন্য খেজুরের রস সংগ্রহের পাত্রগুলো বাঁশের খাঁচা বা মশারি দিয়ে ঢেকে রাখা জরুরি, যেমন জরুরি খেজুরের রস ভালো করে ফুটিয়ে খাওয়া। ফলও খেতে হবে ভালো করে ধুয়ে আর তাতে যদি বাদুরে খাওয়ার কোনো জীবাণু থাকে তবে তা অবশ্যই ফেলে দিতে হবে।
রোগাক্রান্ত প্রাণী বা রোগীকে অবশ্যই গ্লাভস পরে ধরতে হবে আর জোর দিতে হবে বারবার হাত ধোয়ার উপর। মানুষ থেকে মানুষে নিপাহ সাধারনত ছড়ায় স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয়।
কাজেই যারা স্বাস্থ্যসেবার সাথে সম্পৃক্ত তাদের জন্য সাবধানতার মাত্রা আরেক ডিগ্রি বেশি হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কথায় বলে ‘মনে না জানলে, চোখে দেখা যায় না’।
দেশের কোন কোন অঞ্চলে আবারও নিপাহর চোখ রাঙানি দেখা যাচ্ছে। আর তাই পুরোনো কথাগুলো আরেকবার গুছিয়ে লেখায় এই প্রয়াস।
লেখক : অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) – ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ