নির্বাচনকালীন ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক জোট গঠন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন কোনও বিষয় নয়। ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করার বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে স্বাধীনতার পর থেকেই। ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ভোটকেন্দ্রিক জোট গঠনের বিষয়টি রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বহুদিন যাবৎ জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আসছে। রাজনীতির ধারাবাহিকতায় এই জোট গঠন শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট গঠনে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং নির্বাচনের আগে এবং পরেও এই জোটের অস্তিত্ব লক্ষ করা গেছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে ১৪ দলীয় জোট এবং মহাজোট ও বিএনপির নেতৃত্বে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে ২০ দলীয় জোট। এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্য জোট গঠিত হয়েছিল বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে। যদিও নির্বাচনের ফলাফলে সেই জোটের প্রভাব তেমনটা পরিলক্ষিত হয়নি। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি এবং বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করলে ঐক্যজোট ভেঙে যায় এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট রাজনীতিতে খুব বেকায়দায় পড়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কেনই বা নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে জোট গঠন হয় এবং এই জোট ভোটের মাঠে কী প্রভাব ফেলে?
বিভিন্ন বড় রাজনৈতিক দল মূলত দুটি কারণে জোট গঠন করে। প্রথমটি হচ্ছে আদর্শগত জোট এবং দ্বিতীয় হচ্ছে ভোটের হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে জোট। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বড় দুটি দল আদর্শগতভাবে সমমনা বিভিন্ন দলকে নিয়ে জোট গঠনের মাধ্যমে যে বার্তাটি প্রদান করতে চায় সেটি হচ্ছে যে উভয় দলের সঙ্গেই রাজনীতির মাঠে বেশ কিছু দল সক্রিয় রয়েছে। সরকারি এবং বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দেশের মধ্যে জনগণের কাছে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে যে বক্তব্যটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় তা হলো, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই অনেক রাজনৈতিক দলের সমর্থন রয়েছে।
আদর্শগত জোটের বাইরে ভোটের সমীকরণ অনেক সময় বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে অনুপ্রাণিত করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের একটি বড় ভোট ব্যাংক রয়েছে। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জাতীয় পার্টির একটি ব্যাংক রয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর (যদিও এই রাজনৈতিক দলটি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারিয়েছে) দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু সমর্থক রয়েছে। ফলে যখন এই সমর্থনগুলো কোনও একটি বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থনের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন তা ভোটের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। আর এই কারণেই বড় রাজনৈতিক দলগুলো মাঝারি মাপের দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে আগ্রহ প্রকাশ করে।
অন্যদিকে, দেশে কিছু নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল রয়েছে যাদের ভোটের সংখ্যার বিচারে দেশব্যাপী তেমন কোনও জনসমর্থন নেই বিধায় তারা সরাসরি নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এই রাজনৈতিক দলগুলো বেশিরভাগ সময় বড় দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিজেরা উপকৃত হয়। এই রাজনৈতিক দলগুলো জোটের বাইরে থেকে নির্বাচন করলে সংসদে তাদের কোনও প্রতিনিধিত্ব থাকতো না। কিন্তু জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করার কারণে এসব দলের কয়েকজন নেতা বছরের পর বছর শুধু সংসদ সদস্য হিসেবেই দায়িত্ব পালন করছেন না, অনেকে আবার মন্ত্রীও হয়েছেন।
ফলে যে প্রশ্নটি সকলের মধ্যে আলোচিত হয় তা হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি’র মতো রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করলে কতটুকু লাভবান হয়? এ বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। নির্বাচনের সময় সমঝোতার মাধ্যমে আসন বণ্টন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বড় দলগুলোর জন্য ক্ষমতায় যাওয়া অনেক সহজ হয়। কিন্তু আবার পাশাপাশি এটিও ঠিক যে ছোট বা মাঝারি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যদি বড় একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনি জোট করে বেশ কিছু আসন ছেড়ে দেয়, তবে সেই সকল আসনে বড় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, যা ভবিষ্যতে সাংগঠনিকভাবে দলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এর মূল কারণ হলো ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজেদের মনোনয়ন বঞ্চিত হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। আবার সেসব আসনে সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করে রাখা অনেকটা কঠিন হয়ে হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়া যেহেতু রাজনৈতিক দলের মূল উদ্দেশ্য সেহেতু বড় রাজনৈতিক দলগুলো কৌশলগত কারণে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের বিবদমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল একসঙ্গে থেকে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থাকলে তা অনেক সময় দেশ এবং দেশের বাইরে এক ধরনের ইতিবাচক বার্তা প্রদান করতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনার একটি কৌশল হিসেবে এই জোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ ২০১৪ সালে নির্বাচনের কথা বলা যেতে পারে। বিএনপি এবং তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ দলগুলো সেই নির্বাচন বয়কটের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। মূলত নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার কারণে সরকারের মধ্যেও এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ করা গেছে। কারণ, রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সবাই চাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হবে। এই সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত থাকায় নির্বাচনের বৈধতা পাবার ক্ষেত্রে সরকারকে সহায়তা করেছে।
নির্বাচন বয়কটের মাধ্যমে বিএনপি সেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এবং সরকারকে নাজেহাল করতে ব্যর্থ হলেও নিজেরা রাজনীতির আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কারণ, বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে লম্বা সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থেকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী থাকা সম্ভব নয়।
বাস্তবতা হলো গত প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে এই দলটি সাংগঠনিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। ফলে এই দলটি বিভিন্ন সময় সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দিলেও দলীয় নেতাকর্মী ও বাংলাদেশের জনগণ সেই ডাকে সাড়া দেয়নি।
পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দল সরকারে থাকার ফলে গত ১৪ বছরে দেশে যে উন্নয়ন হয়েছে তা সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা এবং ক্ষমতার ধারাবাহিকতার কারণে। পাশাপাশি সমমনা এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অনেক রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জোটবদ্ধ থাকার কারণে নির্বাচনে জয়লাভ করা এবং বিরোধী দলের আন্দোলনকে সামাল দেওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে অনেক সহজ হয়েছে। ভোটের মাঠে এই ধরনের জোটের প্রভাব খুব বেশি না থাকলেও সার্বিকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম এবং দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অনুঘটকদের কাছে ইতিবাচক বার্তা প্রেরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক জোট অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পক্ষে এবং বিপক্ষের শক্তির অবস্থান খুব স্পষ্ট। সেই দিক থেকে বিচার করলে চলমান রাজনীতিতে আদর্শগত রাজনৈতিক জোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বিরোধীদের আন্দোলন সংগ্রামকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে। তাছাড়া এই ধরনের জোটের মাধ্যমে বড় রাজনৈতিক দলগুলো খুব বেশি লাভবান না হলেও সংসদে ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। পরিশেষে বলা যায়, ভোটের মাঠে রাজনৈতিক জোটের প্রভাব বেশি না থাকলেও বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতায় এই ধরনের জোটের প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
লেখক : ড. প্রণব কুমার পান্ডে – অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।