স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৫২ বছরের দ্বার প্রান্তে আমরা। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসে ৩০ লাখ শহিদের রক্ত এবং আড়াই লাখের বেশি নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালির মহান স্বাধীনতা। কিন্তু যুদ্ধকালীন নয় মাসের পূর্বেও সুদীর্ঘ চব্বিশ বছর বাঙালির যে ইতিহাস তাকেও আমরা যুদ্ধের মাসের সঙ্গে অন্বিষ্ট না করে পারি না। মুসলমানদের মধ্যে ‘ভ্রাতৃত্ব বন্ধন’ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে সৃষ্ট পাকিস্তানে বাঙালিদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানিদের যে বৈষম্যমূলক আচরণ, শোষণ, বঞ্চনা ও অবহেলার প্রকাশ সূচিত হয় প্রকৃতপক্ষে সেদিন থেকেই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল বাঙালির সংগ্রাম। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এই সংগ্রাম তীব্রতা লাভের মধ্য দিয়ে কালক্রমে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকেই প্রশস্ত করেছিল।
নানা আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল-জুলুম, হত্যা-নির্যাতন এমনকি নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্টতালাভসহ কৃষক,-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা ও মেহনতি মানুষের প্রবল রক্ত প্রবাহের মধ্য দিয়েই জাতীয় জীবনে আসে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, আসে ২৫ মার্চ, আসে ২৬ মার্চসহ কত আবেগ ও সংগ্রামমুখর উৎকণ্ঠিত মুহূর্ত! পরাধীন জাতিকে মুক্তির আলোকবর্তিকা দেখিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে উদাত্ত আহ্বান বাঙালিকে জানিয়েছিলেন তারই পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ নয় মাসে তিরিশ লাখ শহিদের রক্ত এবং আড়াই লাখ নারীর সম্ভ্রমর বিনিময়ে আমরা পেয়েছি রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটি হেলায়-ফেলায় সৃষ্টি হয়নি, হেলায়-ফেলায় বিশ্বের বুকে পতপত করে উড়েনি আমাদের বিজয়ের লাল সবুজের পতাকা! তাই কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও এমত প্রতিজ্ঞায় নিয়তই নিজেদেরকে শাণিত করে নিই : ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলবো না।’ শহিদের প্রতি বিনম্র স্মরণে আমাদের অমিত, অন্তহীন ও অতল শ্রদ্ধা কার্যকর। দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, যেসব নারীরা নিজেদের অমূল্য সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের ঋণ আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। মনে প্রাণে এই বিশ্বাস নিয়েই আমরা তাদের প্রতি সর্বদা কৃতজ্ঞচিত্তে অবনত।
একটি মহল স্বাধীনতার ৫২ বছরের প্রাক্কালে এসেও বাঙালির সুদীর্ঘকালের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসকে, মহান স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন! বিএনপি নেতা গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বাঙালির দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের অর্জন মহান স্বাধীনতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বয়ান দিয়েছেন! বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তিনি ‘বাই চাঞ্চ স্বাধীনতা’ বলে বিগত ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছেন! শুধু তাই নয় তিনি সংবিধান নিয়েও তির্যক বক্তব্য প্রদান করেছেন। আর তার পেছন-পেছন দোহারকি করে আরেক নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুও সংবিধান নিয়ে গয়েশ্বরের প্রায় অনুরূপ বক্তব্য দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধান সংশোধনেরও ঘোষণা দিয়েছেন! বাংলাদেশের চিন্তাশীল মানুষ, সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসপ্রিয় মানুষ তাদের এ ধরনের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে উভয়েরই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। গয়েশ্বর বাবু ও মিন্টু সাহেবের বক্তব্য বিএনপির দলীয় বক্তব্য কি না কেউ কেউ তাও স্পষ্ট করার জন্য দলটির নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু দেশবাসী এখন পর্যন্ত বিএনপির কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেনি। এরূপ বিষয়ে বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া দেবে সে প্রত্যাশাও অর্থহীন!
আমরা তো বেগম খালেদা জিয়াকেও ইতোপূর্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিতে দেখেছি! গয়েশ্বচন্দ্র এর আগেও এ ধরনের অসংলগ্ন বহু কথা বলেছেন। তিনি তো শহিদ বুদ্ধিজীবিদের ‘বুদ্ধি’ নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক আক্রমণ করেও বক্তব্য দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এসবের প্রতিবাদের চেয়ে বরং এরকম বক্তব্য দানকারীদেরকে উৎসাহই বেশি প্রদান করে!
মূলত ১৯৭১ সালের বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিএনপি যে মনোভাব লালন করে তা অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানকেও হার মানায়! মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেও বিএনপি এবং পাকিস্তানের অবস্থানে তেমন একটা ব্যবধান আমরা দেখিনি! সুতরাং বিএনপি গয়েশ্বর বা মিন্টু সাহেবের বক্তব্যকে সর্বান্তকরণেই মেনে নেবে, মেনে নিয়েছে এ কথাই বলা যায়। আসন্ন নির্বাচনপূর্বকালে জনগণকে তারা এটা বোঝানো চেষ্টা করবে যে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সংবিধান সংশোধন করে জাতীয় নির্বাচন সব সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সম্পন্ন হবে! কিন্তু প্রবাদে আছে ‘কাজির গরু কিতাবে থাকলেও গোয়েলে নেই’! তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত যে লীলা-খেলা করেছিল তা জাতি ভুলে যায়নি। সুতরাং শুধু কিতাব সংশোধন করে তো কোনো লাভ নেই- যদি স্বভাব সংশোধন না হয়!
আমরা বিএনপির স্বভাবের কোনো সংশোধন বিগত চৌদ্দ বছরে প্রত্যক্ষ করিনি! অবশ্য একথাও ঠিক, সংবিধান সংশোধনের বক্তব্য তারা আগেও দিয়েছে! কখনো কখনো আবার সংবিধানেরও তোয়াক্কা করেনি! জিয়া নিজেই সংবিধান কাঁটাছেড়া করে জাতীয় আবেগকে ধুলিস্মাৎ করেছিলেন! অতএব এটি তাদের নতুন কোনো ইস্যু নয়। ২০০১-২০০৬ বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলেও তারা নানা রকমের পরিবর্তনের কথা বলে উস্কানি দিয়ে জাতীয় আবেগকে ক্ষতবিক্ষত করেছে! সেসময় তো জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের জন্যও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপককে দিয়ে প্রস্তাব তোলা হয়েছিল! একথা ঠিক যে, এবার বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে আর কোনো প্রস্তাব বা আলোচনার অবকাশই থাকবে না। জাতীয় মনোভাব উপলব্ধির কোনো রকমের নিরীক্ষায়ও তারা প্রবৃত্ত হবে না! ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ একবার হাতে আসলেই জিয়াউর রহমানের স্টাইলেই মহান সংবিধানের যাকে বলে একেবারে ‘খোল-নলচে’ পাল্টে ফেলবে! সংবিধান ও জাতীয় সঙ্গীতসহ জাতীয় ঐতিহ্যের বিভিন্ন স্মারকও তারা তাৎক্ষণিক ইচ্ছাতেই পাল্টে ফেলবে! কোনো পরিবর্তনেই জাতি মানসিক প্রস্তুতিরও সময় পাবে না! সংবিধান পরিবর্তনের পাশাপাশি তারা জাতির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সংস্কার-সংস্কৃতির ওপরও যে ক্ষমতার দাপট দেখাবে তা নিয়েও সংশয়ের অবকাশ থাকবে না। বিএনপি-জামায়াত বা বিএনপি অন্যকোনো জোটের সঙ্গী হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে সত্যিসত্যি আমাদেরকে ভুলিয়ে দেবে যে, আমরা একদিন বাঙালি ছিলাম!
অতএব চলমান এই যুগসন্ধিক্ষণে সাধারণের অগ্রপশ্চাদ ভাবতে হবে, সচেতনতাবোধ এবং বিবেচনাবোধকে সর্বদা জাগ্রত রাখতে হবে। জাতীয় আবেগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালির হাজার বছরের ধারাবাহিক সংগ্রাম ও সাধনাকে সমুন্নত রেখেই গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আবদুল আউয়াল মিন্টুর বক্তব্যকে ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। গণতান্ত্রিক চেতনা ও বাক স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, স্বাধীন সার্বভৌম দেশে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ক্রমাগত কটূক্তির অবকাশ কাউকে দেয়া আছে!
সম্প্রতি বিএনপি নেতা ড. আবদুল মঈন খান সত্য ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন! ১৪ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজাতীয় আগ্রাসন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এ আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, ‘আজকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস থেকে আমাদের কোমলমতি বালক-বালিকাদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার কাজ চালানো হচ্ছে। আমাদের উচিৎ এখন জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা- সেজন্য আমাদের কাজ করতে হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার দেশ শাসন করে না। তারা বসে বসে ইতিহাস লেখে। কিন্তু সেটা সত্যিকারের ইতিহাস নয়, সেটা কাল্পনিক ইতিহাস। [..] একটি দেশের পরিচয় শুধু উন্নয়ন দিয়ে হয় না। অথবা উন্নয়নের নামে দুর্নীতি দিয়েও একটি দেশের পরিচয় হয় না। বাংলাদেশের একটি শিশু যখন স্কুল-কলেজে যাবে তখন তাকে মুক্তচিন্তা করার সুযোগ করে দিতে হবে। তার সামনে সব তথ্য তুলে ধরতে হবে। এর ফলে সে যখন বড় হবে তখন সে নিজেই বুঝতে পারবে কোনটা করা ঠিক হবে আর কোনটা করা বেঠিক হবে। আমরা কেন এখন থেকে তাকে বলে দেব যে সে কী করবে? সরকার এখন একটা ছোট শিশুর মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ করছে।’
ড. মঈন খানের এসব কথার অনেকগুলোই একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে হয়তো বা সমালোচনার ঊর্ধ্বে। কিন্তু তিনি কোনো সাধারণ নাগরিক নন, একটি রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির নেতা। তার দল সরকারে থাকা অবস্থায় তিনি একাধিকবার মন্ত্রীও ছিলেন। কিন্তু সে সময়কার বিকৃত ও মিথ্যা ইতিহাসচর্চা নিয়ে তিনি কী কোনো সময় তার সরকারকে কোনো ধরনের পরামর্শ বা ‘সবক’ দিয়েছিলেন? দিতে পারেনি! তাই তার এ মন্তব্যে বাঙালি জাতি আজ হাসবে না কাঁদবে তা আমরা সত্যিই ভেবেই পাই না!
এই সেই বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্ব যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েই ক্রমাগত ইতিহাস বিকৃত করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত রেখেছিল দিনের পর দিন। পুরস্কৃত করেছিল জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিদেরকেও! যারা এদেশের ইতিহাসের সমস্ত বইয়ের মলাট থেকে শুরু করে ‘ভেতর-বাহির’ পর্যন্ত ‘তছনছ’ করে ফেলেছিল আজ তারা আলোচনা সভায় বসে জাতিকে সত্য ইতিহাসের ‘সবক’ দেন! মিথ্যা ও বিকৃত তথ্যের ইতিহাসে বিএনপিকে স্বৈশাসক এরশাদও অতিক্রম করতে পারেনি! আফসোস, বাঙালির অনেকগুলো নেতিবাচক প্রবণতার মধ্যে ‘ভুলে যাওয়া’ও একটি!
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতা এসেও আড়াল করে রেখেছিল- জাতি তাও ভুলে যায়নি। তারা তো মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ কিংবা বঙ্গবন্ধুর নামটিও কোনোভাবেই উচ্চারিত হতে দেয়নি এদেশে! শুধু কি তাই? নির্লজ্জভাবে ইতিহাস বিকৃতিকে অবলম্বন করে ১৯৯১ সালে ক্ষমতা গ্রহণকালে বেগম জিয়ার জীবনবৃত্তান্তে মুদ্রিত জন্মতারিখ, পাসপোর্টে থাকা জন্মতারিখ হঠাৎ করে ১৯৯৩ সালে পরিবর্তিত হয়ে যায়! বাঙালির চিত্ত থেকে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নামটি মুছে ফেলার অপপ্রয়াস হিসেবে ১৯৯৩ সাল থেকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসকে বেগম জিয়া তার ‘জন্মদিন’ বানিয়ে তোলেন! ড. মঈন খানের মতো ‘সত্য ইতিহাসের’ কাণ্ডারীগণ তখন কোথায় ছিলেন তা আমাদের জানতে ইচ্ছে করে। আমদের জানতে ইচ্ছে করে বিএনপির বড় বড় নেতারা বিশেষত গয়েশ্বরচন্দ্র, মিন্টু কিংবা মঈন খানরা বাংলাদেশকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চান? কোন ইতিহাসেরই বা জন্ম দিতে চান! কেনই বা তারা নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে এলোমেলো বক্তব্যের ঝড় তুলতে শুরু করেন- আমাদের খুব জানতে ইচ্ছে করে। বিএনপির সত্যনিষ্ঠ (!) ইতহাসচর্চার ভয়ঙ্করী ঐতিহ্য থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই!
লেখক : ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম – অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়