ইদানিং ঢাকাস্থ বিদেশী দূতাবাসগুলোর সঙ্গে যোগাযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন নুরুল হক নুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ভিপিকে তার ফেসবুকে বেশ কয়েকজন বিদেশী কুটনীতিকের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল বৈঠকের ছবি পোস্ট করতে দেখা গেছে। নুরের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বরাতে জানা গেছে,বাংলাদেশের ওপর বিভিন্ন বৈদেশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য নুর বেশ কয়েকজন বিদেশী দূতাবাস কর্মকর্তাকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সুত্র জানিয়েছে, নুরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরো বেশী সক্রিয় হতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বিভিন্ন আন্দোলনের নামে রাস্তায় যথেষ্ট লোকসমাগমে ব্যার্থ হওয়ার পর তাকে এই পরামর্শ দেন কর্মকর্তারা। যদিও নুর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, যথেষ্ট অর্থ না থাকায় তাকে ও তার দলকে সমাবেশ আয়োজনে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে পরিচিতি পেয়ে ডাকসুর নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং ক্রমে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিতর্কিত ও পরিচিতি পান নুরুল হক নুর। শুরু থেকেই নূর ও তার সহযোগীদের সাথে জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট ছিল।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একটা কমন প্লাটফর্ম বেছে নিতে হয়েছে। যেখানে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের যাবতীয় রসদ মিলবে,নাশকতা ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য মিলবে পর্যাপ্ত ফান্ডিং, মিলবে দক্ষ ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রশিক্ষক এবং গাইড। এমন কাউকে প্রয়োজন, যার মধ্যে রয়েছে বর্তমান সরকার এবং বাংলাদেশের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ।
নিজেকে সেভাবে পরিচিত করতে গিয়ে প্রায়ই তাকে বিতর্কিতমূলক কথাবার্তা বলতে শোনা গেছে। উদ্দেশ্য বিদেশী ফান্ড পাওয়া। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে অনুদান পেয়েও টাকাগুলো যথাযথ কাজে লাগাতে পারেননি নুর। করোনা মহামারীতে তার ব্যাবসা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অংশীদারের সঙ্গে তার বিবাদও প্রকাশ্যে এসেছে। ধারণা করা হয়, সেই ব্যাবসা চাঙা করতেই নুর এখন নানা জায়গায় ধর্ণা দিচ্ছেন ।
একইসাথে সরকারবিরোধী আন্দোলন করার জন্য প্রয়োজনে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের হুমকিও দিয়েছেন। যদিও রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কাছে তা কৌতুক মনে হয়েছে। কারণ সাম্প্রতিক সমাবেশগুলোয় নিজের কয়েকজন ব্যাবসায়ীক অংশীদার ছাড়া আর তেমন কাউকে পাশে পাননি নুর। মাঝে ছাত্র শিবিরের পক্ষে কথা বলে চট্টগ্রামে শিবির নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হন তিনি। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়ায় ভেস্তে যায় নুরের পরিকল্পনা।
অবশ্য বর্তমান সরকারবিরোধী আন্দোলনের বিদেশী ফান্ড ঠিকই মিলেছে। এই বিনিয়োগে সবচেয়ে বেশী শোনা গেছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র নাম। দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন বলছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় দেশব্যাপী তান্ডবে পাকিস্তান সরাসরি জড়িত ছিল। ঘটনার তদন্তে হেফাজত ইসলামের একাধিক নেতার সঙ্গে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনগুলোর ঘনিষ্ঠ যোগসাজশের প্রমাণ মিলেছে।
গত বছর গ্রেপ্তারের পর হেফাজত নেতা মামুনুল হক রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ স্বীকার করেছেন, তার ভগ্নিপতিকে পাকিস্তান সরকার নাগরিকত্ব দিয়েছে৷ সেখানে তিনি রাষ্ট্রীয় মদদে একটি জঙ্গি সংগঠনের নেতা হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। মামুনুল হক কয়েকবার পাকিস্তান সফর করেন।
সেখানে লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই-মাহমুদ, তেহরিক-ই-তালিবানসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সাথে তার বৈঠক হয়। বাংলাদেশে আইএসআই’র মদদে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনগুলোর আদলে হেফাজতে ইসলামকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন এবং এজন্য বড় অঙ্কের অনুদান ও পেয়েছেন তিনি।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় দেশজুড়ে আইএসআই’র অর্থায়নে চালান নাশকতা। সে সময় সঙ্গী হিসেবে যুক্ত ছিলেন নুর ও তার সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। নাশকতাকারীদের প্রতিহত করতে গিয়ে নুর ও তার সহযোগিদের হাতে সহিংসতা শিকার হন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। সারাদেশে অনেক জায়গায় পাকিস্তানি জঙ্গিদের মত থানা, ভূমি অফিস, মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনা, শহীদ মিনার, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, সংস্কৃতিকেন্দ্রে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়।
এ সময় নুরের কয়েকজন সঙ্গী গ্রেফতার হলে জঙ্গি কায়দায় তাদেরকে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ নিয়ে মামলাও হয়। সেই মামলার এক আসামিকে ধরার জন্য র্যাবের অভিযান চলছিল। বিষয়টি টের পেতেই নুর এবং তার সঙ্গীরা কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের একটা গোপন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে লিভ ইয়ে গ্রুপ থেকে লিভ নিয়ে গ্রুপটি ডিলিট করে দেন৷ এ নিয়ে নুর ফেসবুকে পোস্ট ও দেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইএসআই তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালে মধ্যপ্রাচ্যে আইএসআইর এমন প্রোপাগাণ্ডা চালানোর বিষয়টি জানাজানি হলে তাদের একটি টুইটার একাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরে দেখা গেছে, ভারতবিরোধী কাজে আইএসআই টুইটার একাউন্টটি চালাতো। এই করোনার মধ্যেই বাংলাদেশে একইভাবে আইএসআই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চালাচ্ছে অপতৎপরতা। আইএসআই’র এজেন্টরা ঢাকায় বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রথম আলো।
প্রতিবেদনটির বরাতে জানা যায়, ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধি নিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালু করে৷ মুলত আইএসআই নেপথ্যে থেকে ওই গ্রুপের মাধ্যমে ধর্মকে পুজি করে প্রতিনিয়ত উস্কানিমূলক নানা প্রচারণা চালায়। যার ভয়াবহ ফলাফল দেখা গেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার সময়।
এভাবে আইএসআই নিজেদের স্বার্থ হাসিলে মিথ্যা গুজব ও অপপ্রচারের পাশাপাশি বানোয়াট তথ্য ছড়াচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন কুটনৈতিক পর্যায়ে চিঠি লিখে অভিযোগ জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রত করতে পরামর্শ দিচ্ছে তারা।
আপাতত নুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শটি মেনে নিয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই তাকে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন গুজব ও প্রোপাগাণ্ডা নিয়ে হাজির হতে। সর্বশেষ নুর দাবি করেছেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশকে অবাঞ্জিত ঘোষণা করতে যাচ্ছে জাতিসংঘ। মুলত গুজব ছড়িয়ে সেনাবাহিনীকে উসকানি দিতেই তার এই মিথ্যাচার বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে সরকারের উপরমহলে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, নুরকে কোনো পর্যায়ের রাজনীতিবিদই মনে করে না সরকার। সে মানুষের আবেগ ঠকিয়ে খাচ্ছে, তাকে অহেতুক গুরুত্ব দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার পরিকল্পনা সরকারের নেই। জনগণই একসময় তার প্রতারণা বুঝে নিবে।